
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। ছবি: এএফপি
২০১১ সালের মধ্য মার্চে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে শিগগিরই সরকারি দমননীতিতে তা অশান্ত বিদ্রোহ ও এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
বিভিন্ন বিদেশি শক্তি নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক স্থানীয় গ্রুপগুলোকে মদদ জুগিয়েছে। গৃহযুদ্ধে ধসে পড়েছে সিরিয়ার অর্থনীতি। মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। এমন এক অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে সিরিয়া।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০১১ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি ৩০ লাখ, যার অর্ধেকই এখন ঘরহারা। ৮০ শতাংশ সিরীয় দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ৬০ শতাংশ জনগণই খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। দেশটির অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এখন এক মার্কিন ডলারের মূল্যমান প্রায় চার হাজার সিরীয় পাউন্ড। অথচ এক বছর আগেও তা ছিল ৭০০ সিরীয় পাউন্ড। আর ২০১১ সালে তা ছিল ৪৭ সিরীয় পাউন্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সিরিয়ার ওপর একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ২০১১ সাল থেকেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ছিল সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তার সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞায় সিরীয় বা অ-সিরীয়, যারা আসাদ সরকারের সাথে ব্যবসায়িক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে, এমনকি ত্রাণ সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত থাকলেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ফলে মানবিক বিপর্যয় আরো ত্বরান্বিত হয়েছে।
সিরিয়ায় এসব নিষেধাজ্ঞা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিরই অংশ। যে কারণে জো বাইডেন ক্ষমতায় এলেও এসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সিরিয়ায় সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ প্রতিনিধি জেমস জেফরি বলেন, রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল করতে এসব নিষেধাজ্ঞা জরুরি ছিল। রুশ প্রভাব কমলে আসাদ সরকারকে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। সিরিয়ার পুনর্গঠনকে অসম্ভব করে তোলার জন্যই ট্রাম্প প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও তেলক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, যা সিরিয়াকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাতে অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোর সুরক্ষা দিচ্ছে। অথচ সিরীয় বা অ-সিরীয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে ওই তেলক্ষেত্র মেরামত করতে দিচ্ছে না। তেল সরবরাহ না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। সেখানকারে জনগণ দিনে মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পান। আবার তেলক্ষেত্র থেকে অপরিশোধিত তেল গিয়ে পড়ছে খাবুর ও ইউফ্রেটিস নদীতে। এসব নিষেধাজ্ঞা শুধু সিরীয় জনগণকে দুর্ভোগে ফেলছে না, তাদের পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, ২০১১ সালে যেখানে ১ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করতেন, সেখানে ২০১৫ সালে তা পৌঁছায় ৩৫ শতাংশে। লেবাননের সাথে সিরিয়ার অর্থনীতি ভীষণভাবে যুক্ত ছিল। লেবানন দেউলিয়া হওয়ার পর সিরিয়ার অর্থনীতিও পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। খাবারের দাম বেড়েছে ২০৯ শতাংশ, একইভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষেরে নাগালের বাইরে চলে যায়। খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি।
২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইউরোপীয় নেতারা ভেবেছিলেন, একটু জোর দিলেই আসাদ সরকারের পতন হবে ও তাদের সমর্থিত নতুন সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে; কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। মার্কিন-ইউরোপীয় সমর্থিত আসাদবিরোধী নেতাদের জনগণের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। এমনকি তারা বিরোধীদের মধ্যে ঐক্য গঠনেও সমর্থ হয়নি। এরপর ২০১২ সালে সিরিয়ায় পাঠানো হয় দেড় হাজারেরও বেশি সিআইএ প্রশিক্ষিত মিলিশিয়া। ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া যুদ্ধে প্রবেশ করে রাশিয়া।
মার্কিন সমর্থিত কোনো কোনো মিলিশিয়া গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয় বলেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া প্রবেশের পর সিরিয়া হয়ে ওঠে বহু গ্রুপের যুদ্ধক্ষেত্র।
যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে, রাশিয়া আইএস দমনের অজুহাতে তাদের সমর্থিত বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা করছে। অন্যদিকে রাশিয়াও অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যেন রাশিয়া ও সিরীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র আসাদ। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটি বিমান ঘাঁটি ও একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে শান্তি আলোচনায় রাজি হলেও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে রাশিয়া আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাটা ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানও সমর্থন করে আসাদকে। ২০১২ সাল থেকেই তেহরান আসাদ সরকারকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সিরিয়ায় ইরানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তাদের সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারাও রয়েছে। সেইসাথে রয়েছে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ। এর বিপরীতে, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের আসাদবিরোধী সক্রিয় ভূমিকাও রয়েছে। সৌদি আরব একাধিক ওয়াহাবি ধারার ইসলামপন্থী গ্রুপকে সহায়তা দিয়ে থাকে। আবার সিরিয়া যুদ্ধের ভেতরেই কুর্দিরা তুরস্ক সীমান্তে একটি নতুন ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযানে রয়েছে তুরস্ক। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য কুর্দিদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। তাদের দাবি, সিরিয়ার কুর্দিরা পিকেকের সাথে যুক্ত। পিকেকে কুর্দিদের একটি সংগঠন, যারা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে।
জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সিরিয়ায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, নতুন সংবিধান ও গোত্রগত শাসনের বদলে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় পশ্চিমা গোষ্ঠী। এই রাজনৈতিক সংস্কারের মানেই হলো- ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়, এটি বাশার আল-আসাদ ও তার মিত্ররা বেশ ভালোই জানেন। তাই এমন সংস্কারে তারা কখনোই রাজি হবেন না। ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র, তার মদদপুষ্ট বাহিনী ও আইএস সন্ত্রাসীরা সিরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। গত ১০ বছরে আসাদ যে গোত্রের, সেই আলাওয়াতি গোত্রের লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। যা আলাওয়াতিদের প্রতি ২৫ জনে একজন। এত মানুষ হত্যার পর সিরিয়ায় এ মুহূর্তে আসাদ সরকারের বিদায় মানেই হলো- আরেকটি নতুন গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাক্স বলেন, ‘মূলত চারটি কারণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট শক্তি আসাদকে উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, শুধু আলাওয়াতিরাই নয়, সুন্নি ইসলামপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কায় সে দেশের খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও আসাদকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ইরান ও রাশিয়ার ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তৃতীয়ত, আইএস থেকে যেসব ছোট ছোট গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের সামাল দিতে আসাদ উৎখাতে নিয়োজিত জোটকে আলাদাভাবে খরচ করতে হয়েছে। সর্বশেষ কারণ হলো- আসাদবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বড় ধরনের কোন্দল রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে গিয়ে আসাদ উৎখাতে সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করতে পারেনি।’
এদিকে ১০ বছর ধরে আরব লিগ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরাক সম্প্রতি সিরিয়াকে জোটে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে। ইতিমধ্যে আরব লিগের বিভিন্ন সংস্থা সিরিয়ায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। আমিরাতের সমর্থন পাওয়ার মানে হলো- আসাদ প্রশ্নে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানও নমনীয়। এখন গৃহযুদ্ধের ১০ বছর পার করে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে আসাদ ও তার সমর্থকরাই এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন; কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে দেশ ও জনগণ।