
ছবি: বিশ্ব মানচিত্র ব্লগ
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু গত ৬ মার্চ থেকে ৯ মার্চ মধ্য এশিয়ার তিন দেশ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তান ঘুরে এসেছেন।
তিনি মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ উজবেকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আশা করেন। মধ্য এশিয়া সফরের ব্যাপারে তুর্কি মিডিয়াকে কাভুসোগলু জানান, তার সফর শুধু ব্যাপক সফলই ছিল না, তা ছিল আন্তরিক ও ফলপ্রসূ।
তিনি আরো জানান, উজবেকিস্তানের সঙ্গে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি করার কথাবার্তা চলছে। এটি সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে কথা শুরু করতে চান। দুই দেশের বাণিজ্য বর্তমানের ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চান তারা।
এছাড়াও গত বছরের অক্টোবরে তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারের উজবেকিস্তান সফরের সময় দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তুর্কমেনিস্তান তুরস্ককে রাজধানী তুর্কমেনাবাদ থেকে টারকিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চলাচল করতে দিচ্ছে, যদিও সেখান থেকে অন্য দেশের ফ্লাইট চলাচল করে না। এছাড়াও কাস্পিয়ান সাগরে আজারবাইজান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে তুরস্ক যৌথভাবে ‘দোস্তলুগ’ তেলখনি নিয়ে কাজ করছে।
সফরকালে কিরগিজস্তানের তুর্কি-কিরগিজ মনাস ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত আনতালিয়া ডিপ্লোম্যাসি ফোরামে তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘২১ শতক হবে এশিয়ার শতক। সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্ধেক এখন এশিয়ার। এ কারণেই তুরস্ক চাইছে এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে।’
তিনি আরো বলেন, “বহু বছর ধরে ‘তুর্কি দুনিয়া’ আলাদা হয়ে ছিল ‘কৃত্রিম দেয়াল’এর কারণে। এই দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পর তুরস্ক ও ‘তুর্কি দুনিয়া’ একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে।” এ প্রসঙ্গে ২০০৯ সালে গঠিত তুরকিক কাউন্সিলের কথা উল্লেখ করেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি নাগোর্নো কারাবাখে আজারবাইজানের যুদ্ধ জয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের এক লেখায় সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা পল গোবল বলেন, আজারবাইজানের যুদ্ধ জয়ের পর বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনায় থাকা ‘লাপিস লাজুলি’ করিডোর নতুন জীবন পেয়েছে। এই করিডোর আজারবাইজান ও তুর্কমেনিস্তান হয়ে আফগানিস্তানকে তুরস্কের সঙ্গে যুক্ত করবে। একই সূত্রে বাঁধা আফগানিস্তান। ১২ মার্চ কাভুসোগলু নিশ্চিত করেন যে, এপ্রিল মাসে ইস্তাম্বুলে আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনা হতে চলেছে।
এর আগে ৭ মার্চ আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেল টিওএলও নিউজ জানায়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কাছে এক চিঠি দিয়ে জানান যে, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আফগান শান্তি আলোচনার ভেন্যু হতে অনুরোধ করেছে। ব্লিংকেনের এই চিঠিই বলে দিচ্ছে, আফগানিস্তানে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের সমন্বয় রয়েছে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তুরস্কের সেন্টার ফর ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল স্টাডিজের উপদেষ্টা মেসুত হাক্কি কাসিন বলেন, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রয়েছে। এদের মাঝে কৌশলের সমন্বয় জরুরি। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন, তুরস্কের চিন্তার কেন্দ্র এখনো ইইউ। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো তুরস্কের মাধ্যমে ইইউ পৌঁছাতে পারে।
অপরদিকে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক অর্থমন্ত্রী সালমান শাহ বলেন, ‘তুরস্ক যেমন ইউরোপে ঢোকার পথ, পাকিস্তানও তেমনই চীন এবং মধ্য এশিয়াতে ঢোকার পথ। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র, যখন চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া হয়ে তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে।’
একইসঙ্গে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর হাতেই থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তুরস্ক ও পাকিস্তানের মাঝে অনুষ্ঠিত ‘আতাতুর্ক-২০২১’ যৌথ সামরিক মহড়ার কথা মনে করিয়ে দেন।
তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ইউসুফ এরিম মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ম্যাগাজিনের এক লেখায় তিনি বলেন, ‘তুরস্ককে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বেশ হিসাব করেই রুশ প্রভাবকে ব্যালান্স করতে হচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে তুরস্কের সহযোগিতা থাকার কারণেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটি সুযোগ।’ তিনি মনে করছেন, দুই দেশের উচিত ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং সিরিয়ার কুর্দি ওয়াইপিজি মিলিশিয়া ইস্যুকে প্রাধান্য না দিয়ে মধ্য এশিয়া বিষয়ে একটা সমন্বিত কৌশলের ব্যাপারে একমত হওয়া। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর লিউক কোফি তুর্কি মিডিয়া টিআরটি ওয়ার্ল্ডে এক লেখায় ন্যাটো, মধ্য এশিয়া ও ইউক্রেনে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার রাস্তা খোলা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারাস কুজিও তুরস্কের সরকারি মিডিয়া আনাদোলু এজেন্সিতে এক লেখায় তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকা উচিত বলে মত দেন।
মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে; যখন ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর উজবেকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের মৃত্যু হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিইয়োয়েভ ২০১৭ সালের অক্টোবরে তুরস্ক সফরে যান। সঙ্গে সঙ্গে মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের দুয়ার খুলে যায়। তবে আদর্শিক দিক-নির্দেশনা না থাকার কারণে তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো কৌশলগত দিক থেকে এখনো জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। এ কারণেই দেশগুলো একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গ চাইছে, অন্যদিকে উইঘুর ইস্যুতে কথা বলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছে না।
উসমানি খিলাফতের সময়ের ইতিহাসের ওপর ভর করে গড়ে ওঠা ভূরাজনৈতিক আকাক্ষা থেকে তুর্কি জনগণকে যখন আলাদা করা কঠিন, তখন মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রভাব বিস্তার করা হবে আরো বেশি কঠিন। কারণ মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তার মানেই রাশিয়া ও চীনের দুশ্চিন্তা। আর একইসঙ্গে তা যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া ও চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবে।