
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির প্রধান মুখ। এবার তিনিই নন্দীগ্রাম বিধানসভার প্রার্থী। মমতার এই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এক সময়কার তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী।
বিজেপি শক্ত অবস্থান গড়তে পারায় ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০টি, অমিত শাহ ও জে পি নাড্ডা ৫০টি করে সভা করছেন। তবে মমতাও ছেড়ে কথা বলছেন না। তিনিও তার মতো করে সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপিকে প্রতিহত করতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাই বলা চলে এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ‘অগ্নিকন্যা’খ্যাত মমতার জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।
১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেস দিয়ে শুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মজীবন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্থানীয় কংগ্রেস নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় সাফল্য। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রয়াত হওয়ার পর রাজ্যের রাজনৈতিক পটভূমি কিছুটা বদলে যায়।
আজ আবারো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ রাজ্যে তারই এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বিজেপিকে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সমূলে উৎপাটিত করতে ব্যস্ত। প্রবল রাজনৈতিক চাপ রয়েছে তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর।
১৯৮৪- সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদদের অন্যতম। এই সময় তিনি সারা ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ায় তিনি তার কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন; কিন্তু ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে পুনরায় সাংস নির্বাচিত হন। এর পর তিনি ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৯১ সালে নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানব সম্পদ উন্নয়ন, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে খেলাধূলার প্রতি সরকারি ঔদাসিন্যের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।
১৯৯৩ সালে তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার দলের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-কে সহায়তা করার অভিযোগ আনেন। নিজেকে দলের একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ বলে উল্লেখ করে তিনি এক “পরিচ্ছন্ন কংগ্রেস”-এর দাবি জানান। কলকাতার আলিপুরে একটি জনসভায় গলায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লোকসভার ওয়েলে বসে পড়েন তিনি। এই সময়ই সমাজবাদী পার্টি সাংসদ অমর সিংহের জামার কলার ধরে তার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় রেল বাজেট পেশের দিন পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে রেল বাজেট পেশ চলাকালীনই তদনীন্তন রেলমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে নিজের শাল নিক্ষেপ করেন তিনি। পরে তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দেন। কিন্তু লোকসভার তদনীন্তন অধ্যক্ষ পি. এ. সাংমা তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করে তাকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে সন্তোষমোহন দেবের মধ্যস্থতায় তিনি ফিরে আসেন।
১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এর কিছুকাল পরেই তার দল দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সমাজবাদী পার্টি সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজ “মহিলা সংরক্ষণ বিলের” বিরোধিতায় লোকসভার ওয়েলে নেমে গেলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জামার কলার ধরে টানতে টানতে তাঁকে ওয়েলের বাইরে বের করে দেন। এই ঘটনায় কিছু বিতর্কেরও সৃষ্টি হয় তখন।
১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে সামিল হন। এই জোট সরকার গঠন করলে তিনি রেলমন্ত্রী মনোনীত হন। এই সময় তিনি পর্যটন উন্নয়নের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে তিনি দুটি নতুন ইঞ্জিন চালু করেন এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এছাড়া ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নির্মাণের ব্যাপারে ভারতের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাংলাদেশ ও নেপাল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া লাইনগুলি আবার চালু করার কথাও বলেন। ২০০০-২০০১ আর্থিক বছরে তিনি মোট ১৯টি নতুন ট্রেন চালু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০১ সালের প্রথম দিকে একটি রাজনৈতিক মতবিরোধের পর এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ত্যাগ করেন। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তার দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। তবে সেবার এই জোট বামফ্রন্টকে পরাজিত করতে অসমর্থ পারেনি । এর পর ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আবার এনডিএতে ফিরে আসেন এবং কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত একমাত্র তৃণমূল সাংসদ।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের শিল্পনীতির বিরোধিতা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । ইন্দোনেশিয়ার সালিম গোষ্ঠীর মালিক বেনি সান্তোসা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে এলে সরকার তাকে হাওড়ার একটি কৃষিজমি কারখানা স্থাপনের জন্য দেন। এর পরই রাজ্যে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে টাটাদের সিঙ্গুরের গাড়ির কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। যে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য রাজনীতিতে উত্থান এবং এই আন্দোলনের জেরেই ২০১১ সালে রাজ্যের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে মমতা পরাজিত করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসেন।
আজ ১০ বছর রাজ্য প্রশাসন চালিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে এখন বড় সমস্যা তারই সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী । একদিকে শুভেন্দু-রাজীব-বিজেপি; অপরদিকে এক হাতেই লড়ে চলেছেন মমতা। এবার রাজ্যে ‘গেরুয়া ঝড়’ থামাতে হয়তো তার কোনো বিকল্প নেই পশ্চিমবঙ্গের- এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।