পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন : ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনে আরেকটি ধাপ

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ মে ২০২১, ০৯:২০

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে শেষ ধাপের ভোটগ্রহণ হয়েছে ২৯ এপ্রিল। ফল ঘোষণা আজ রবিবার (২ মে)। ২৯৪ আসনের লড়াইয়ে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় এলে যে তা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিকাশে এক মাইলফলক অতিক্রম করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে ক্ষমতায় না এলেও ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে যে উত্থান তাদের হয়েছে, তাতে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও মনস্তত্ত্ব নির্মাণের ভিত তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা আসন রয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) একাই ৩৪টি আসনে জয়ী হয়। চারটি আসন জেতে কংগ্রেস এবং দুটি আসন যায় বামদের দখলে। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ ভোট, বামফ্রন্ট ৩০ শতাংশ এবং কংগ্রেস ১০ শতাংশ।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। অথচ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে ভাগ বসায় বিজেপি। এবারের চিত্র এর চেয়েও ভিন্ন। ২০১৯ সালে বিজেপি কার্যত সিপিএমের ভোটে নিজের ভিত গড়েছিল। আর এখন তারাই টিএমসির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিস্তারে দুটি বিষয় বিশেষভাবে কাজ করেছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রথমটি হলো- দেশভাগ ও পুরনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি এখন আর সেভাবে কার্যকর নেই। দেশভাগ-পরবর্তী প্রজন্ম বা এখনকার ছেলে-মেয়েদের সেই দুঃসহ স্মৃতির অভিজ্ঞতা না থাকায়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজনটুকুও অনেকের কাছে নেই।
দ্বিতীয় বিষয়টিই সম্প্রতি অনেক বেশি করে ঘটছে। বিজেপির প্রচারণার মূলে রয়েছে- পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত বহিরাগত বা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ তাড়ানোর তাগিদ। প্রচারণার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে ভয়ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছে- মুসলিম জনসংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাচ্ছে; প্রচণ্ড গতিতে মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। সুতরাং আরেকটি পার্টিশন হবে। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে এমন প্রচারণা গত বছর বিশেক ধরে ব্যাপক হারে করা হচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে যখন অযোধ্যায় রাম মন্দির আন্দোলন হচ্ছিল, ওই সময় থেকেই নির্বাচনী প্রচারে এই ইস্যুটি ঢুকে পড়ে। ওই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে, যেমন- মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), হিন্দু মহাসভা ও বিজেপির প্রচারণায় বলা শুরু হয়- এখানেও বিদেশিদের চিহ্নিত করে তাদের তাড়াতে হবে। একেক সময় এই ইস্যুটি খানিকটা প্রচার পেয়েছে, আবার স্তিমিত হয়ে গেছে; কিন্তু গত দশ বছরে এটি খুব বেশি করে উঠে এসেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিজেপির সামনে চলে আসা, একের পর এক রাজ্যে সরকার গঠন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর হিন্দুত্বকরণ, দলীয়করণে তারা গত তিন-চার বছরে খুব বেশি করে বহিরাগত তত্ত্বকে নিজেদের প্রচারণার অংশ করে তুলেছে। এই প্রচারণার পেছনে যে সাম্প্রদায়িকতা, এটি এখন আর গোপন কিছু নয়। এই প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক প্রচারণা যে এগিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলায় একসময় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক মতবাদ ছিল; দেশভাগের আগে তা বেশ বড় পরিসরেই ছিল- হিন্দু কিংবা মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িকতাই ছিল। তবে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি না থাকায়, আরএসএস বা বিজেপি সেখানে ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। তবে এবার তারা নতুন ধরনের প্রচার শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে। এর আগে তাদের প্রচার বা উপস্থিতি তেমন ছিল না, সে কারণে তাদের নেতৃস্থানীয় লোক সবাই অন্য রাজ্য থেকে আসছে।
পাশাপাশি এখানে বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মতবাদ বা দাবিগুলোয়, যা উত্তর ভারতে প্রচলিত আছে। উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত ধারণা, স্লোগানগুলো এখন পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। ‘জয় শ্রীরাম’, ‘লাভ-জিহাদ’, ‘গো-রক্ষা’- এগুলো কোনোটিই কিন্তু বাংলার সংস্কৃতির অংশ নয়। এটি দাবি করার চেষ্টা হচ্ছে- বাংলা সংস্কৃতি হলো হিন্দু সংস্কৃতি; বাংলা ভাষাও হিন্দুদের ভাষা- মুসলমানরা এ ভাষা ‘বিকৃত’ করছে; বাঙালির ঐতিহ্য আসলে হিন্দুর ঐতিহ্য- এইভাবে একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদ আমদানি করার চেষ্টা করছে বিজেপি-আরএসএস। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক সাজসজ্জা, যেমন- গেরুয়া পোশাক পরে মিছিলে হাঁটা, এই বিষয়গুলোকে নতুন করে তুলে আনা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে। এই নতুন সাংস্কৃতিক পট-পরিবর্তনের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি।
তবে সরকারে আসার জন্য বা নির্বাচনে জেতার জন্য কৌশল হিসেবে একাধিক প্রচারের বিষয়কে তারা হাতিয়ার করছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রচারণার সঙ্গে রয়েছে তৃণমূল সরকারের প্রতি নানা কারণে মানুষের ঊষ্মা ও অশ্রদ্ধা, অর্থাৎ তৃণমূল বিরোধিতার প্রকাশ এবং কথিত উন্নয়নের স্বপ্ন। উল্লেখ্য, তৃণমূলের ভিন্নমত দমনের ফলশ্রুতিতেই সিপিএমের ভোট ব্যাংক হাতাতে পেরেছে বিজেপি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল মতিনের মতে, পশ্চিমবঙ্গে এখন যে ভয়ঙ্কর হিন্দুত্বের আবহ তৈরি হয়েছে, সেটি একসময় গুজরাট, উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রেই শুধু ভাবা হতো। সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ অনেক ভিন্ন। তবে পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের ‘সাইলেন্ট কমিউনালিজম’ অপারেট করে। এ ‘সাইলেন্ট কমিউনালিজম’ এতদিন রাজনৈতিক হাওয়া পায়নি। এখন পেয়েছে। আর এটি তখনই হয়, যখন একটি বড় সংখ্যক মুসলিম টেক্কা দিতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের বড় কোনো উত্থান না ঘটলেও সেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটছে। আর এটিকেই থ্রেট বলে চালানো হচ্ছে- এবার হয়ত মুসলিমরা রাজ্যটা দখল করে নেবে!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মমতাজ বেগম’ বলা হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চাশ বছরে সমাজ সংস্কার হয়নি। এখনো বলা হচ্ছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্রদের কথা; কিন্তু উপনিবেশ-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সমাজ সংস্কারের এজেন্ডা কোনো রাজনৈতিক দলও নেয়নি, কোনো সামাজিক সংগঠনও নেয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান সেখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করছে। এই পরিবর্তন শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়। সামগ্রিকভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এজেন্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হচ্ছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক এজেন্ডা। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদের যে সাংস্কৃতিক আধিপত্য রয়েছে, সেই আধিপত্য অন্যান্য জায়গায় নেই। দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিকভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য নেই তাদের, সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দির দাপট আরও কম। আসামেও স্থানীয়দের জাতিগত আন্দোলনের চাপে রয়েছে তারা। তবে পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চিতভাবে তাদের কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যদি হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করা যায়, উত্তরপ্রদেশে সরকার বা সরকারি মুখপাত্রদের যে ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে, সেটি যদি পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই হিন্দুত্ববাদের বিশেষ অগ্রগতি বাস্তব হয়ে দেখা দেবে।
বিজেপির এ উত্থানকে নিশ্চিতভাবেই ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পথে আরেক ধাপ অগ্রসরতা বলেই ধরে নিতে হবে। ভোটে না জিতেও যে এমপিদের কিনে নিয়ে সরকার গঠন করা সম্ভব, সে নজির বিজেপি একাধিকবার বিভিন্ন রাজ্যে রেখেছে। আর একবার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, সরকারি সব ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা থাকবে সর্বাত্মক। উত্তর ভারতে যেমনটি হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই হয়তো তখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াবে, যার ভিত্তি মুসলিম ও দলিত পীড়ন।
এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, অথবা দলীয়করণের মাধ্যমে ‘এক ব্যক্তি, এক পার্টি, এক দেশ, এক নীতি’র ভিত্তিতে এক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রবর্তন করা হচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।