Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

বাগরাম ছাড়লো মার্কিন বাহিনী, ফের গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি আফগানিস্তানে

Icon

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২১, ১১:৩০

বাগরাম ছাড়লো মার্কিন বাহিনী, ফের গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি আফগানিস্তানে

বাগরাম ঘাঁটিতে মার্কিন বাহিনীর বিমান অবতরণ করছে। ছবি : ডয়চে ভেলে

যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর শেষ সদস্যরা আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে গেছে। প্রায় ২০ বছর ধরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কেন্দ্র ছিল বিশাল বাগরাম বিমান ঘাঁটি। এই ঘাঁটি থেকেই বিদেশি বাহিনী তালেবান ও আল কায়েদার ওপর হামলা চালিয়েছে।

তাদের বাগরাম ছেড়ে যাওয়ার অর্থ হল আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া খুব শিগগিরি সম্পন্ন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

আর রাজধানী কাবুলের উত্তরে বিস্তীর্ণ এই ঘাঁটি খালি করে সেনাদের চলে যাওয়া আফগানিস্তানে বাজিয়েছে গৃহযুদ্ধের দামামা। তালেবান দেশটির বহু এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এ অবস্থায় কোনোরকম ছাড় দিতে তালেবান স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহী নয় বলে মন্তব্য করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো। তারা হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে আফগান সরকারকে কোণঠাসা করতে চাইছে।

বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহার অক্ষরিক অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। তালেবানের সাথে হওয়া শান্তিচু্ক্তির অংশ হিসেবে বিমান ঘাঁটিটি খালি করে দেয়া হয়েছে।

বাগরাম বিমানঘাঁটি নিরাপত্তায় নিয়োজিত আফগান সেনা।

ওই চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলা হলেও, যুক্তরাষ্ট্র টুইন টাওয়ার হামলার কথা বিবেচনা করে ১১ সেপ্টেম্বরকে সেনা প্রত্যাহারের শেষ দিন হিসেবে ঘোষণা করে। ওই সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় তিন হাজার মানুষ।

হামলা চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠী আল কায়েদা। তালেবানের সহায়তায় তখন তাদের মূল ঘাঁটি ছিল আফগানিস্তানে। ওই বছরই পরের দিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট দুটি গোষ্ঠীকেই পরাজিত করতে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়।

আফগানিস্তানে ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকার অধিষ্ঠিত হয়। এক পর্যায়ে তারা হয়ে ওঠে ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা। 

তালেবানের পুনরুত্থান

যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সবচেয়ে দীর্ঘ এই লড়াইয়ের অবসান চাইছে। এই যুদ্ধে বহু প্রাণহানি হয়েছে। অর্থের হিসাবেও এই যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে বিশাল। যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগান সরকারের হাতে দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিতে চাইছে।

কিছুদিন আগে পর্যন্তও আফগানিস্তানে প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সৈন্য ছিল। তারা চলে যাবার পর এক হাজারের কম মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে থাকবে। মে মাস নাগাদ আফগানিস্তানে জোট বাহিনীর অন্যান্য দেশের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার। ধারণা করা হচ্ছে, এদের বেশিরভাগই আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে। জার্মানি ও ইতালিও গত বুধবার ঘোষণা করেছে দেশটিতে তাদের মিশন শেষ।

এদিকে বিদেশি সেনাদের চলে যাবার খবরে আশান্বিত তালেবান আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা বেশ কিছু জেলায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। বিদেশি বাহিনী পুরোপুরি দেশ ত্যাগ করার পর নতুন করে আবার গৃহযুদ্ধ বাধার আশংকা রয়েছে।

বিবিসির আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী বিষয়ক প্রধান সংবাদদাতা লিস ডুসেট বলেন, বাগরাম ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক নির্দেশক। মার্কিন সামরিক শক্তির প্রতীক এই বিমান ঘাঁটি একসময় সোভিয়েত বাহনীর দখলে ছিল। খুবই শিগগিরি শহরের মধ্যে এই বিস্তীর্ণ ও ব্যস্ত বিমানঘাঁটি এলাকার দখল নেবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে।

তিনি বলেন, বাগরামের দখল নেয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতীকী অর্থে ও কৌশলগত কারণেও এই বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়া জরুরি। তালেবান যোদ্ধারা দেশটির বিভিন্ন জেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে যেভাবে এগোচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট যে তাদের নজর বাগরামের ওপর। বাগরাম বিমান ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে যে শহর এলাকা গড়ে উঠেছে অক্টোবরে সেখানে গিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের তিনি বলতে শুনেছেন তালেবান শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

ডুসেট আরো বলছেন, মার্কিন বাহিনী যখন বিমানঘাঁটি ছাড়ার জন্য তল্পিতল্পা গুছাচ্ছিলো তখন সেখানে গিয়ে তিনি বিদেশি সেনাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে মিশ্র মনোভাব লক্ষ্য করেছেন।

বিমান ঘাঁটির দেয়ালের ভেতর রয়েছে বিপুল পরিমাণ সামরিক রসদের ভাণ্ডার। এই অস্ত্র সম্ভারই তালেবানের জন্য শীর্ষ টার্গেট। তবে এই বিমান ঘাঁটিকে ঘিরে যে জনপদ ও জীবিকা গড়ে উঠেছে, যার ওপর বহু সাধারণ মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করছে, তারা এখন তাদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিতাগ্রস্ত।

ডুসেট বলছেন, বাগরামের যে নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।

বাগরাম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ


বাগরাম বিমান ঘাঁটিটি কাবুলের ৪০ কিলোমিটার (২৫ মাইল) উত্তরে। এর নামকরণ কাছের একটি গ্রামের নামে। বাগরাম বিমান ঘাঁটিটি গড়ে তুলেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যখন তারা ১৯৮০এর দশকে আফগানিস্তান দখল করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী সেখানে যায় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এবং এই ঘাঁটির পরিসর তারা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। সেখানে একসাথে ১০ হাজার সৈন্য থাকতে পারে।

বাগরামে বিমান ওঠানামার জন্য দুটি রানওয়ে আছে, এর মধ্যে নতুন রানওয়েটি ৩.৬ কিলোমিটার লম্বা। সেখানে নামতে পারে বিশাল মালবাহী বিমান ও বোমারু বিমান। বিমান পার্ক করার জন্য সেখানে ১১০টি জায়গা আছে। এগুলো বিস্ফোরণ প্রতিরোধী দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত।

সংবাদ সংস্থা এপি’র খবর অনুযায়ী, এলাকার মধ্যে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, জরুরি সেবার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা, অস্ত্রোপচারের জন্য তিনটি অপারেটিং থিয়েটার ও আধুনিক সরঞ্জামবিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসার ক্লিনিক। 

সেখানে আছে সংঘাতের সময় গ্রেফতার হওয়া বন্দিদের কারাগার। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন এই কারাগার পরিচিত হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তানের গুয়ান্তানামো নামে। আল কয়েদা সন্দেহভাজনদের সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে মার্কিন সিনেটের একটি রিপোর্টে এই কারাগারের নাম উঠে আসে। কিউবার গুয়ান্তানামোয় কুখ্যাত মার্কিন কারাগারের মত আফগানিস্তানের কারাগারেও বন্দীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর কথা জানা যায়।

ভবিষ্যতের আফগানিস্তান 

এপি বলছে, প্রায় ৬৫০ জন মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে থেকে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রহরায় সহায়তা করবে ও কূটনীতিকদের সুরক্ষা দেবে। তারা বর্তমান এই বিমানবন্দরের নিরাপত্তার কাজ করছে ন্যাটোয় মার্কিন মিত্র দেশ তুরস্কের সৈন্যদের সাথে হাত মিলিয়ে। আফগান সরকারের সাথে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে। বাকিরা কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে প্রহরার কাজ করবে।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাবুলকে সুরক্ষিত রাখতে ও তালেবানকে দূরে রাখতে আফগান সরকার কতটা সফল হয়, তা নির্ভর করবে দেশটির সরকার বাগরামের নিয়ন্ত্রণ কতটা বজায় রাখতে সক্ষম হয় তার ওপর।

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এর আগেই গত সপ্তাহে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক করেন। আফগানরা এবার নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরই গড়ুক সেটিই ছিল বৈঠকে বাইডেনের কথা। আর গনি বলেছিলেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিণতি সামাল দেয়াটাই এখন তার কাজ।

এদিকে দেশটিতে ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে, সেটির রূপরেখাও তালেবানের করা হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তালেবানের প্রতিনিধি মো. নাঈম জানান, ‘শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা আফগানিস্তানে শান্তি অর্জন করতে বদ্ধ পরিকর এবং পরবর্তী ধাপে সেখানে সম্পূর্ণ ইসলামিক শরিয়া আইন মোতাবেক পরিচালিত হবে এমন একটি সরকার গঠন করা হবে।’

২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসন কাঠামোতেও যেকোনো ভিন্নমত তারা নৃশংসভাবে দমন করেছে। সেখানে না ছিল নারীদের কোনো অধিকার, না ছিল মিডিয়া। দুই দশকের মার্কিন আগ্রাসনে কথিত গণতন্ত্রের মূলা ঝুলিয়ে এখন সেই নিপীড়ক কাঠামোকেই কথিত শান্তি চুক্তির নামে আফগানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে বিশ্ব মোড়লরা।

তালেবানের প্রতিক্রিয়া

তালেবানের এক মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ বাগরাম থেকে মার্কিন সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারকে স্বাগত জানিয়ে এএফপিকে বলেছেন,এর মধ্যে দিয়ে আফগান জনগণের নিজেদের ভবিষ্যত নির্ধারণের পথ প্রশস্ত হবে।

তবে তালেবান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে নারাজ। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তির আওতায় তালেবান কোয়ালিশন বাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করলেও আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করেনি। আফগানিস্তানে কোয়ালিশন বাহিনীর আগমনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত গত জুন মাসেই সবচেয়ে বেশি তালেবান সহিংসতা দেখা গেছে।

দেশটির পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রাতভর লড়াইয়ের নতুন নতুন খবর প্রতি সকালেই পাওয়া যাচ্ছে। হেরাত, বাদাখশান, বাঘলান ও পাকটিকায় তালেবানের সাথে সরকারি বাহিনীর লড়াই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। 

২০ বছরের যুদ্ধে হতাহত

ধারণা করা হয়, এই লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৪৭ হাজারের বেশি বেসামরিক আফগান ও প্রায় ৭০ হাজার আফগান সৈন্য। একইসাথে নিহত হয়েছে দুই ৪৪২ মার্কিন সৈন্য, তিন হাজার ৮০০’র বেশি মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং জোট বাহিনীতে অন্যান্য দেশের এক হাজার ১৪৪জন সৈন্য। - বিবিসি, রয়টার্স ও ডয়চে ভেলে

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫