ইথিওপিয়ার টিগ্রে অঞ্চল
মানবাধিকার সংস্থা ২৫ জুন ‘ডক্টরস উইথআউট বর্ডার্স’ বা ‘এমএসএফ’এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের তিনজন কর্মীকে ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত টিগ্রে অঞ্চলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, টিগ্রে অঞ্চলের আবি আদ্দি শহরে ‘টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’ বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলারা তাদের অপহরণ করে হত্যা করেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক সংবাদ থেকে জানা যায়, গত মার্চ মাসে ‘এমএসএফ-এর ত্রাণকর্মীরা আক্রমণের শিকার হয়।
তারা অভিযোগ করেন, তারা ইথিওপিয়ার সেনাদেরকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত হতে দেখেছে।
‘এমএসএফ-এর কর্মী হত্যার কয়েক দিন আগেই ২২ জুন তিগ্রে অঞ্চলের তোগোগার বাজার এলাকায় বিমান হামলায় ৬৪ জনের প্রাণহানি হয় এবং ১৮০ জন আহত হয়। ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স যেতেও বাধা দেয় ইথিওপিয়ার সেনারা। তবে ইথিওপিয়ার সরকার ঘটনার দায় পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করে। গত নভেম্বরে শুরু হওয়া ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ এরিত্রিয়ার সেনারা ইতিমধ্যেই ইথিওপিয়ার পক্ষে তিগ্রেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধ এমন এক সময়ে চলছে, যখন নীল নদের ওপর বাঁধ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ভাটির দেশ মিসর ও সুদানের সঙ্গে ইথিওপিয়ার সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এমতাবস্থায় অতি দরিদ্র এই দেশটায় সংঘাত নিরসন এবং অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার্থে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি জাতিগতভাবে বিভক্তি ইথিওপিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হচ্ছে।
‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর আফ্রিকা বিশ্লেষক কনর ভ্যাসি বলেন, হর্ন অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো ইথিওপিয়া। এই অঞ্চলের সংঘাতপূর্ণ সোমালিয়া, সুদান এবং দক্ষিণ সুদানে ইথিওপিয়ার সেনা মোতায়েন রয়েছে। পশ্চিমারা এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইথিওপিয়াকে মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখে। তবে দেশটির বর্তমান অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোকে ইথিওপিয়ার ওপর নির্ভর করাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশটা অস্থির থাকলে সুদানের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা এবং নীল নদের ওপর বাঁধের ব্যাপারে বিরোধের নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে যাবে। আর সাড়ে ১১ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ অস্থির হওয়াটা পুরো অঞ্চলের জন্যই চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমারা মনে করছে যে, তারা যদি প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সরকারের ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে, তবে তারা হর্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব হারাবে। সে কারণেই ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারটাকে পশ্চিমারা তেমন কঠোরভাবে দেখছে না। দেশটায় চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে। তাই পশ্চিমারাও চাইছে না নিজেদের প্রভাব ছেড়ে দিতে।
সুদানের মন্ত্রী ইয়াসির আব্বাস বলেন, ইথিওপিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ আদ্দিস আবাবার সরকারকে ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা ছাড়াই নীল নদের ওপর বাঁধের প্রকল্পের কাজকে এগিয়ে নিতে আরও বেশি একরোখা করেছে। এমতাবস্থায় সুদান চাইছে, জাতিসংঘ এ ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা নিক। ১৫ জুন আরব লীগের দোহা বৈঠকে আরব দেশগুলোও মিসর ও সুদানের পক্ষে একই দাবি জানায়।
মন্ত্রী আব্বাস সাংবাদিকদের সামনে ইথিওপিয়ার বর্তমান সরকারের টিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযানের ব্যাপক সমালোচনা করেন। দুই দেশের মাঝে অবিশ্বাস এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে উল্লেখ করেন।
সুদান সরকারের জবাবে ইথিওপিয়ার সরকার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলে, আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতৃত্বে যে আলোচনা চলছে, সেই আলোচনাকে নষ্ট করতেই মিসর ও সুদান জাতিসংঘকে এই সমস্যায় জড়িত হতে বলছে এবং এখানে আরব দেশগুলোকে ডেকে নিয়ে আসছে।
‘টাইমস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার প্রশ্ন করেছেন, ইথিওপিয়া তার বর্তমান কাঠামোতে আদৌ একটা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি-না। ১৯৯১ সাল থেকে ইথিওপিয়ার ক্ষমতা ছিল টিগ্রেদের হাতে, যারা জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের পর থেকে অরোমো এবং আমহারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা ক্ষমতায় আসে, যারা কি-না জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। তবে প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার মতোই ইথিওপিয়াতেও বহুকালের একনায়কতন্ত্র শেষ হবার পর সব জাতিগোষ্ঠীই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ক্ষমতা নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশটাতে জাতিগত সংঘাত শুরু হয়ে যায়। ঠিক এ সময়েই টিগ্রেরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ইথিওপিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার কথা বলতে শুরু করে।
ইথিওপিয়ার সরকারি সেনারা টিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অপারেশন শুরু করে এবং সেখান থেকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবরাখবর আসতে থাকে। যে পশ্চিমারা এক সময় আবি আহমদকে গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহক হিসেবে দেখেছে এবং তাকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে, তারাই এখন তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছে। জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টিগ্রে জনগণ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। শুধু ইথিওপিয়া নয়, পার্শ্ববর্তী এরিত্রিয়ার সেনারাও টিগ্রেদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
রয়টাসের মতে, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে, তারাও টিগ্রেদেরকে না খাইয়ে মারার চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় ইথিওপিয়া জাতিগত বিভেদের ওপর ভিত্তি করে লেখা সংবিধানের ওপর নিজেদের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি? দেশটা কিন্তু তার ইতিহাসে রাজতন্ত্র, সামরিক একনায়ক, সাংবিধানিক গণতন্ত্র সব কিছুই দেখেছে।
ইথিওপিয়ার জটিল সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বর্তমান বিশ্ব নিয়মহীনভাবে চলছে। ‘আল মনিটর’- এর মতে, মে মাসের শেষ সপ্তাহে মিসর এবং সুদান ‘গার্ডিয়ান অব দ্য নাইল’ নামে একটা বড়সড় যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। যদিও উভয় দেশের সরকার বলছে যে, এই মহড়ার সঙ্গে নীল নদের ওপর ইথিওপিয়ার বাঁধের কোনো সম্পর্ক নেই; তথাপি কথা থেকেই যাচ্ছে।
মিসরের ‘নাসের হাই মিলিটারি একাডেমি’র অধ্যাপক মেজর জেনারেল নাসর সালেম বলেন যে, এই মহড়া ইথিওপিয়াসহ মিসরের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যে কোনো দেশের জন্যে একটা বার্তা।
ইথিওপিয়াকে ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপারে নাসর সালেমের কথাগুলোকে ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভেদের সঙ্গে যুক্ত করতেই হবে। আফ্রিকান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার নীল নদের বাঁধের আলোচনায় জড়িত হবার ব্যাপারে ইথিওপিয়া এবং আরব দেশগুলোর বিরোধ লক্ষ্যণীয়। আবার আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ হর্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ইথিওপিয়ার সংঘাতকে থামাতে কঠোর পদক্ষেপও নিচ্ছে না। আসলে ইথিওপিয়া ধসেপড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।