আবারও বিদ্রোহ দমনের নামে দুর্ভিক্ষের কবলে টিগ্রে

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২১, ০৯:২৭

ফাইল ছবি
ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত টিগ্রে প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনী ও টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে টিগ্রে আবারও এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮০-এর দশকে যেমন দুর্ভিক্ষের মূলে ছিল সরকারি দমন-কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা; তেমনি এবারও দুর্ভিক্ষের মূলে রয়েছে একই মানবসৃষ্ট কারণ।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, টিগ্রে অঞ্চলে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে রয়েছেন; দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে রয়েছেন নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ইরিত্রিয় বাহিনী ও তার সহযোগীরা যখন এ দুর্ভিক্ষকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যত রয়েছে নীরব ভূমিকায়- তারা দূর থেকে বুলি আওড়েই দায় সারছে।
দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা এবারই প্রথম দেখছে না ইথিওপিয়া। এর আগে ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তখনো টিগ্রে অঞ্চলই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। খরাকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অথচ দুর্ভিক্ষ কখনোই একমাত্র খরার কারণে হয় না। পরে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইথিওপিয়ার প্রতিটি সংকটই কার্যত বিদ্রোহ দমনের কৌশল; বিশেষ করে ১৯৮৩-৮৫ সালে বিদ্রোহ দমনে সরকারি নীতির ফলেই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। টিগ্রে অঞ্চলের জনগণের খাদ্য, ফসল, খামার ধ্বংস করা হয়। সেখানে সেনাদের বিধ্বংসী হামলার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করার কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
এবারও পরিস্থিতি একই দিকে মোড় নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। টিগ্রেতে গত নভেম্বর থেকে সংঘর্ষ চলছে সেনাবাহিনী ও টিপিএলএফের মধ্যে। সেই লড়াইয়ের ফলে টিগ্রের ৯১ শতাংশ মানুষের জরুরিভিত্তিতে খাদ্যসাহায্য দরকার বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি)। তারা জানিয়েছে, সেখানে ক্ষুধা মেটাতে গেলে ২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার দরকার।
ডব্লিউএফপির মুখপাত্র টমসন ফিরি জানিয়েছেন, ‘টিগ্রের ৫২ লাখ বা সেখানকার ৯১ শতাংশ মানুষ অভুক্ত। এত মানুষের কাছে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা খুবই শঙ্কিত।’
ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, টিগ্রের অবস্থা এতটাই অস্থির যে, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানোই যাচ্ছে না। মার্চ থেকে তারা ১০ লাখ মানুষের কাছে জরুরিভিত্তিতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে; কিন্তু এখন যে জায়গায় পরিস্থিতি পৌঁছেছে, তাতে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। প্রায় নয় লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে রয়েছেন। ৩৩ হাজার শিশু আসন্ন মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে।
টিগ্রের অবস্থা বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সাহায্য বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক বলেছেন, ‘ওই অঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। সেখানে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।’ জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত এক সমীক্ষায় ভিত্তিতে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ ধরনের বিশ্লেষণকে বলা হয় ইন্টিগ্রেটেড ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত টিগ্রে অঞ্চলে সাড়ে তিন লাখ মানুষ ‘গুরুতর সংকটের’ মধ্যে বসবাস করছেন। গত বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের কারণে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ওই আইপিসি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, টিগ্রে অঞ্চলে খাদ্য সংকট ‘বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতিতে চলে গেছে, যার ফলে ক্ষুধার্ত মানুষ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়, মে পর্যন্ত ৫৫ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগেছে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। তবে এই রিপোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষের কথা ঘোষণা করা হয়নি। কিছু শর্ত পূরণ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা একমত হওয়ার পরেই কোনো এলাকায় ‘দুর্ভিক্ষ’ ঘোষণা করা হয়। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মন্বন্তরে সোমালিয়ায় মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ মানুষের। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল শিশু। টিগ্রের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ বলে মনে করা হচ্ছে। শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ বলে জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
এদিকে, গত সপ্তাহে ইথিওপিয় সেনাদের হটিয়ে টিগ্রের রাজধানী মেকেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে টিপিএলএফ। মেকেলের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, টিপিএলএফ বাহিনী আবার রাজধানীতে ঢুকে পড়েছে। ইথিওপিয়া সরকার যে প্রশাসক ও অন্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ করেছিল, তারা অনেকেই শহর ছেড়ে পালিয়েছেন।
টিপিএলএফের মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ‘রাজধানী শহর এখন আমাদের দখলে।’ উল্লেখ্য, ইথিওপিয়ায় নতুন সরকার গঠনের আগে থেকেই টিগ্রের ক্ষমতা ছিল টিপিএলএফের হাতে। নভেম্বরে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে এক পর্যায়ে রাজধানী থেকে পিছু হটে বিদ্রোহীরা। এখন আবারও রাজধানী তাদের দখলে এসেছে।
উল্লেখ্য, এখন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী আবি আহমেদ। ২০১৮ সালে ২০ বছর ধরে চলে আসা ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। অথচ এখন তিনি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়ই আরও একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিচ্ছে টিগ্রে অঞ্চলে। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। তবে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মহলের বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নয় আবি আহমেদের সরকার। তাদের দাবি, ওই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক ত্রাণ সাহায্যের কর্মসূচিও বিস্তৃত করা হচ্ছে।
যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ বাসিন্দার বাস্তুচ্যুতি, নিত্যনৈমিত্তিক প্রতিবন্ধকতা এবং বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি মারাত্মক অবহেলা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির পেছনে কাজ করছে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয়টি সামনে এনেছেন মার্ক লোকক।
তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, এই যুদ্ধে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ইথিওপিয় প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সমর্থনে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়া থেকে আসা বাহিনী টিগ্রয়ী জনগণকে অনাহারে বাধ্য করে বিদ্রোহ মোকাবেলার চেষ্টা করছে। অনেক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী। এক নারীকে ২৩ জন মিলে ধর্ষণ করার অভিযোগও উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, সরকার সমর্থক সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণের ফসল ও শস্যের দোকানে আগুন দিচ্ছে এবং জমি চাষে ব্যবহৃত গবাদি পশু জবাই করছে।
মার্ক লোকক জানান, টিগ্রের অর্থনীতি, ব্যবসা, ফসল এবং খামার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যাংকিং ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ নাজুক। তিনি ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপিকে জানিয়েছেন, ‘মাস দুয়েকের মধ্যে সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতে না পারলে দুর্ভিক্ষ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ৯০ শতাংশ ফসল লুট হয়েছে বা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ৮০ শতাংশ গবাদি পশু চুরি হয়েছে বা মেরে ফেলা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে সাহায্যের চালানও বন্ধ করে দিয়েছে। মে মাসে জাতিসংঘের ১৩০টি সহায়তা সরবরাহ আটকে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০৮টি ঘটনায়ই বাধা দিয়েছে ইরিত্রিয় অথবা ইথিওপিয় সেনারা অথবা তাদের যৌথ বাহিনী। এ ছাড়া ২১টি সহায়তা সরবরাহে বাধা দিয়েছে আমহারা মিলিশিয়া বাহিনী, যারা টিগ্রয়ীদের প্রতিপক্ষ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সহায়তায় বাধা দেওয়ার আরেকটি ঘটনা ঘটিয়েছে টিগ্রয়ীদের একটি বিরোধী দল। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, একটি জনগোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃত দুর্ভিক্ষে রাখার বিষয়টি চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এরই মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর হামলা, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের হাজারো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। জাতিসংঘের ভাষায়, ‘এটি হচ্ছে চিন্তার বাইরে নিষ্ঠুরতার একটি মাত্রা।’
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সহায়তা স্থগিত করেছে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইথিওপিয়ার উপর। জি-৭ সম্মেলনে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সব এলাকায় বিনা বাধায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ প্রদান এবং দ্রুত ইরিত্রিয় বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ নেই।