ইসরায়েলি সফটওয়্যার
বিশ্বজুড়ে ফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ১৩:১০
পেগাসাস স্পাইওয়্যার ইসরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি সফটওয়্যার। ছবি : বিবিসি
ইসরায়েলের তৈরি একটি হ্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের ফোনে নজরদারি চালানোর একটা ঘটনা ফাঁস হয়েছে।
‘পেগাসাস’ নামের ওই স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে মূলত কর্তৃত্ববাদী সরকার এই নজরদারি চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টসহ মোট ১৭টি সংবাদপত্রের অনুসন্ধানে হ্যাকিংয়ের এই ঘটনা বেরিয়ে আসে।
ফোনে নজরদারির অস্ত্র ‘পেগাসাস স্পাইওয়্যার’
পেগাসাস স্পাইওয়্যার ইসরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি সফটওয়্যার, যা মোবাইলে আড়ি পাতার অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। ফোনে কী কথাবার্তা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপে কী আদান-প্রদান হচ্ছে সবই জানা যায়। ফোনে কী তথ্য, নথি, ছবি রয়েছে সেটাও দেখে ফেলা যায় এর মাধ্যমে। অথচ যার মোবাইল হ্যাক করা হয়েছে, তিনি জানতেই পারেন না।
এ বিষয়ে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেসে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পরে তারা গার্ডিয়ানসহ ১৭টি সংবাদমাধ্যমকে তা জানায়। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দেয় ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।
গার্ডিয়ান বলছে, ফাঁস হওয়া ওই ডেটাবেসে ৪৫টি দেশের ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া যায়। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশগুলোর। এছাড়া পেগাসাসের মাধ্যমে সারা বিশ্বের যে ১৮০ সাংবাদিকের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছে সেই তালিকায় রয়েছেন সম্পাদক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বিটে কর্মরত সাংবাদিকেরা। আছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা, অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি), এএফপি, ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকাসহ আরো কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক।
সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার আগে ও পরে তার ঘনিষ্ঠজনদের মুঠোফোনে এই পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে আড়ি পাতা হয়েছিল। ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফরেনসিক বিশ্লেষণ বলছে, আড়ি পাতা হয় খাসোগির স্ত্রী হানান এলাতার ও তার বাগদত্তা হেতিজে চেঙ্গিসের ফোনে। খাসোগি হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ দুই তুর্কি কর্মকর্তার ফোনেও এভাবে আড়ি পাতা হয়।
এছাড়া এই হ্যাকিংয়ে লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় ভারতের অন্তত ৩০০ রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম থাকার কথা জানিয়েছে দেশটির নিউজ পোর্টাল দ্য অয়্যার। এর মধ্যে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক ছাড়াও ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরও আছে।
এই ম্যালওয়্যারটি আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে পারে। পাশাপাশি কল রেকর্ড ও গোপনে মাইক্রোফোন চালু রাখতে পারে।
এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাবের পরিচালক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘যদি কোনো স্মার্টফোনে পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ অচিরেই নজরদারির মুখে থাকা মানুষের নাম প্রকাশ করবে। এছাড়া এনএসও অন্তত ৪০টি দেশের সামরিক বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পেগাসাস বিক্রি করেছে।
এদিকে সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই দাবি করে এনএসও আইনি পদক্ষেপ নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
এনএসও’র এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘রিপোর্ট যা বলা হয়েছে সব ভিত্তিহীন। মনগড়া থিওরির উপর নির্ভর করে এই রিপোর্ট তৈরি। রিপোর্টে বলা হয়েছে অসমর্থিত সূত্রের থেকে তথ্য পেয়েছে তারা। এই তথ্য বাস্তব থেকে অনেক দূরে। সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। তারা যে অভিযোগ তুলছে তার পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছে না। এই অভিযোগ বাস্তব থেকে এতটাই দূরে যে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে এনএসও।’
সংস্থাটি জানিয়েছে, কিছু সাধারণ তথ্যের উপর ভিত্তি করে মনগড়া একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। কারণ এনএসও শুধু পেগাসাস স্পাইওয়্যার তৈরি করে। সেটা কোনো দেশের সরকার বা কোনো সরকারি এজেন্সি নিজেদের কাজে লাগাতে পারে। সংস্থার নিজের কাছে কোনো তথ্য থাকে না।
এনএসও’র তরফে আরো দাবি করা হয়েছে, তারা কোনো দেশের সরকার বা সরকারি এজেন্সিকে এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে যাতে মানুষের জীবন রক্ষা করা যায় বা জঙ্গি হানা আটকানো যায়। কারও জীবনহানির ক্ষেত্রে এই স্পাইওয়্যারের কোনো ভূমিকা নেই। এছাড়া মাদক চক্র, নারী পাচার চক্র, নিখোঁজ বা অপহরণ হওয়া শিশু, দুর্ঘটনার ফলে কোথাও আটকে থাকা মানুষদের চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহার করা হয় পেগাসাস।
এনএসও মানুষের জীবন রক্ষাকারী একটি সংস্থা। তারা কখনো এমন কাজ করবে না যাতে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। - ডেইলি স্টার ও আনন্দবাজার পত্রিকা
