
ফাইল ছবি
গত ২৩ জুন ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা যুদ্ধ জাহাজ কৃষ্ণ সাগরে রুশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবার পর থেকে ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মাঝে কাঁদা ছোড়াছুড়ি চলছে। রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার ‘ডিফেন্ডার’ রাশিয়ার সমুদ্রসীমায় ঢুকে পড়লে রাশিয়ার সীমান্তরক্ষী যুদ্ধ জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করে সতর্ক করা হয় এবং একটা ‘সুখোই- ২৪’ যুদ্ধবিমান থেকে কয়েকটি বোমা জাহাজটির কাছাকাছি ফেলা হয়।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে যে, ব্রিটিশ জাহাজটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অমান্য করেছে। রুশ বার্তাসংস্থা ‘তাস’ জানাচ্ছে যে, ঘটনার পর ব্রিটিশ সামরিক এটাশেকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়।
অপরদিকে টুইটারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ‘ডিফেন্ডার’কে লক্ষ্য করে কোনো সতর্কতামূলক গোলাবর্ষণ করা হয়নি। বরং জাহাজটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে ইউক্রেনের সমুদ্র সীমানা ‘নিরপরাধভাবে অতিক্রম’ করছিল। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতাদের বলেন, রাশিয়ার এই দাবির ব্যাপারে তিনি অবাক হননি; কারণ রাশিয়ার সঙ্গে এরকম ঘটনা নিয়মিত ব্যাপার।
২৪ জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ক্রিমিয়ার উপকূলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের চলাচল পুরোপুরি সঠিক ছিল। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে ব্রিটেন মস্কোকে চ্যালেঞ্জ করে যেতে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা ব্যবহার করাটা পুরোপুরি সঠিক ছিল; এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ব্রিটেন রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার স্বীকৃতি দেয়নি। মূলত বরিস জনসনের কথাগুলো এই দ্বন্দ্বকে সংজ্ঞায়িত করে। ব্রিটেন ক্রিমিয়াকে এখনো ইউক্রেনের অংশ হিসেবে দেখছে এবং ক্রিমিয়ার সমুদ্রসীমানাকেও ব্রিটেন দেখছে ইউক্রেনের এলাকা হিসেবে; রাশিয়ার এলাকা হিসেবে নয়। অপরদিকে ব্রিটেন ও রাশিয়া উভয়েই ক্রিমিয়ার মালিকানার সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার কথা বলছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিজের সমুদ্রসীমা থেকে হাজার মাইল দূরে ব্রিটেন কৃষ্ণ সাগরে কী করছে?
‘ডিফেন্ডার’ ব্রিটিশ রয়াল নেভির দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে এসেছিল। সেই গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে ‘ডিফেন্ডার’ এবং ডাচ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘এভারস্টেন’ কৃষ্ণ সাগরে ঢোকে। ঘটনার দুই দিন আগে ২১ জুন ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে ‘ডিফেন্ডার’এর ডেকের উপর ইউক্রেনের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, গত অক্টোবরে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক ব্রিটেন ইউক্রেনের জন্য ৮টি ছোট দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করবে এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির পুরনো দুটি মাইন সুইপার জাহাজ ইউক্রেনকে দেবে। ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জন্য দুটি নৌ ঘাঁটি তৈরিতেও সহায়তা দেবে ব্রিটেন। একইসঙ্গে এই প্রকল্পের জন্য ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নও ব্রিটিশ সরকারই করছে। এ ছাড়াও ইউক্রেনের বর্তমান কিছু যুদ্ধবিমানকেও পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র বহন করার জন্যে উপযোগী করার কথা উল্লেখ করা হয়। তদুপরি ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট তৈরির প্রকল্পেও সহায়তা দেবে ব্রিটেন।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়ন ফেলো ব্রায়ান হুইটমোর বলছেন যে, ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর থেকে এই এলাকায় উত্তেজনা চলছে; ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে রুশদের এই দ্বন্দ্ব সেই উত্তেজনারই অংশ। ক্রিমিয়ার আশপাশে কৃষ্ণ সাগরে আন্তর্জাতিক আকাশসীমানায় মার্কিন এবং ব্রিটিশ সামরিক বিমান নিয়মিত টহল দিচ্ছে। রুশ যুদ্ধ বিমান সেগুলোকে আকাশে বাধা দিচ্ছে। ‘ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনে’র সিনিয়র ফেলো স্টিভেন পাইফার এই ঘটনাকে ‘চায়ের কাপে ঝড়ে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, রাশিয়া বলতে চাইছে, পশ্চিমারা রাশিয়ার সীমানায় আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে; আর রাশিয়া নিজ সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করছে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়া বলতে চাইছে, পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়া নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে; অপরপক্ষে রুশ সরকার নিজ জনগণের কাছ থেকেও সমর্থন চাইছে।
তবে তিনি বলেছেন, রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরের শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করে যেতে থাকবে এবং পশ্চিমারাও রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে যেতে থাকবে।
কৃষ্ণ সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ নতুন নয়। ১৮৭৮ সালে ইস্তাম্বুলের উপকণ্ঠে রুশ সেনাবাহিনী হাজির হলে ব্রিটেনের বাধায় রাশিয়া পিছু হঠতে বাধ্য হয়। কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বসফরাস প্রণালির নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেন রাশিয়ার হাতে ছাড়তে রাজি নয়; তাই বসফরাসের নিরাপত্তা কথা বলে ব্রিটেন সাইপ্রাসে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে; যা আজও রয়েছে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে উসমানি খিলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলো ভাগবাটোয়ারা করার সময়েও বসফরাস প্রণালির নিয়ন্ত্রণ যেন রাশিয়ার কাছে চলে না যায়, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করে ব্রিটেন। ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লাউস্যান চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন বসফরাসের নিয়ন্ত্রণ দেয় লীগ অব নেশনসের হাতে। তবে ১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিস্ট ইতালি এবং নাজি জার্মানির আবির্ভাবের পর ১৯৩৬ সালে ‘মনট্রিউ কনভেনশন’-এর মাধ্যমে নতুন করে বসফরাসের নিয়মগুলো ঠিক করা হয়; যেগুলো আজও বলবৎ রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইলে কৃষ্ণ সাগরে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের আগমন ঘটে এবং চারদশক তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেই নির্ভরশীল থাকে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষে ২০০৪ সালে কৃষ্ণ সাগরের দেশ রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হলে কৃষ্ণ সাগরে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা শুরু হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে। এরপর ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ সমর্থিত সরকারের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয় এবং রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়।