Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে হাইতি

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২১, ১৪:২৮

ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে হাইতি

ফাইল ছবি

অনেক আগে থেকেই ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতি স্বৈরশাসন, অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত ছিল। সন্ত্রাসী হামলায় দেশটির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়িস নিহত হওয়ায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী, কারা ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরাসরি বিদেশি হস্তক্ষেপ কমলেও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাষ্ট্রটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আর এখন কার্যত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে হাইতি। 

গত ৭ জুলাই হাইতির রাজধানী পোর্ট অ-প্রিন্সে ময়িসের বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। তাদের গুলিতে প্রাণ হারান দেশটির প্রেসিডেন্ট। গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী মার্টিন ময়িসও। এরপর থেকে হামলাকারীদের ধরতে কঠোর অভিযান শুরু করে হাইতির নিরাপত্তা বাহিনী। পরের দিন সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক গোলাগুলি হয়। সেদিন হাইতির পুলিশপ্রধান লিওন চার্লস সাংবাদিকদের জানান, ‘এই দলে ২৮ জন আততায়ী ছিল। ২৬ জনই কলম্বিয়ান। মূলত তারাই প্রেসিডেন্ট হত্যার অপারেশন চালিয়েছে। ১৫ জন কলম্বিয়ান ও ২ জন আমেরিকানকে গ্রেফতার করেছি। ৩ জন কলম্বিয়ান নিহত হয়েছে। পলাতক আরও ৮ জন।’ কলম্বিয়ানদের ভেতরে কয়েকজন আবার নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। 

ঘাতক দলটির যে দুই হাইতিয়ান-আমেরিকান গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের একজনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে, যা যে কাউকে অবাক করে দিতে পারে। গ্রেফতার দুই ঘাতক জেমস সোলাগেস ও ভিনসেন্ট জোসেফ ফ্লোরিডার বাসিন্দা। জেমস একটি মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড রিপেয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। সেই সঙ্গে তিনি হাইতিতে কার্যরত একটি দাতব্য সংস্থার পরিচালনা পরিষদের সভাপতি। তিনি হাইতিতে কানাডা দূতাবাসের নিরাপত্তা প্রধানও ছিলেন। ভিনসেন্ট জোসেফের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনিও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানা গেছে।

তবে হাইতিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং এতে মার্কিন সংযোগ নতুন কিছু নয়। হাইতিতে এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর সঙ্গে মার্কিন আগ্রাসন ও স্বৈরশাসন সরাসরি জড়িত। যেটি রাষ্ট্র হিসেবে হাইতিকে কখনোই শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই হাইতিসহ ক্যারিবীয় ও লাতিন অঞ্চলজুড়ে মার্কিন প্রভাব বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে সামরিক আগ্রাসনও বাড়তে থাকে। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরাসরি আগ্রাসন চালায় হাইতিতে। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে দেশটির প্রেসিডেন্ট জিন ভিলবার্ন গিলোম স্যাম আততায়ীর হাতে নিহত হন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন হাইতির অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কয়েক হাজার মেরিন সৈন্য পাঠান। তখন থেকেই দেশটির বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীতে মার্কিন প্রভাব বাড়তে থাকে। 

১৯৯০ সালে তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী এমন ১০ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬৮ শতাংশ ভোট লাভ করেন বামপন্থী ধর্মযাজক জ্য বার্ট্রান্ড অ্যারিস্টাইড। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র আট মাসের মাথায় তাকে উৎখাত করে মার্কিন সমর্থিত সামরিক বাহিনী। সামরিক শাসকরা দেশটির ওপর নৃশংসতা চালায়, যার কারণে হাইতির হাজার হাজার শরণার্থী সমুদ্রগামী নৌকায় চেপে পালিয়ে যান পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। অ্যারিস্টাইডের প্রত্যাবর্তনের দাবিতে জনমতের জবাবে সাহসী এ ধর্মযাজককে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ বলে মিথ্যা প্রচারণা চালায় মার্কিনপন্থীরা।

হাইতির বিশৃঙ্খলা এতটাই বেড়ে যায় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯৯৩ সালে হাইতির সামরিক শাসক রাউল চেদ্রাসকে অপসারণ করা ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কোনো উপায় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য হাইতির সেনাশাসকদের গ্রেফতার করার বিপরীতে তাদের নিরাপত্তা এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন নিশ্চিত করে।

হোয়াইট হাউস বরাবরই বলে আসছে, তারা হাইতিতে স্থানীয় নেতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তবে তারা দেশটিতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে বরাবরই উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর বাইরে নয়। ১৯৯৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের দুই বছর পর ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট রটবার্গ বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাইতিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পররাষ্ট্রনীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগও হাইতির পিছু ছাড়েনি। একের পর এক সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২০১০ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও এর পরবর্তী কলেরা মহামারিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এ সময় শান্তিরক্ষা ও মানবিক সাহায্যের নামে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা পাঠায়। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাইতিতে জন্ম নেওয়া অধ্যাপক রবার্ট ফ্যাটন বলেন, ‘শান্তিরক্ষার নামে চলা অভিযানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এক সময় যাদের হাইতিয়ানরা রক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, তাদেরই পরে বিদেশি আগ্রাসন হিসেবে দেখেছে।’

হাইতির বস্তিগুলো যেসব অপরাধী চক্রের দখলে ছিল, বিদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের সরিয়ে সেখানে সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পেরেছিল। এক ধরনের সাম্যাবস্থা বিরাজ করছিল। তবে বিদেশি বাহিনী হাইতি ছাড়ার পর স্থানীয় অপরাধী চক্রগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সার্বিক অবস্থা আবারও সহিংস হয়ে ওঠে। অধ্যাপক রবার্ট ফ্যাটনের মতে, হাইতিতে বিদেশি সাহায্যের ধরনটা এমনই ছিল- তারা সামরিক জোরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে, ত্রাণ পাঠিয়েছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে আরও ভঙ্গুর করেছে। যা পরবর্তী সময়ে পুরোপুরি ধসে পড়েছে। 

উল্লেখ্য, শাসক হিসেবে জোভেনেল ময়িজও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন, তা নয়। ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিশেল মার্তেলি পরবর্তী নির্বাচনে জোভেনেল ময়িজকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন। সে বছর তিনি ৩২.৮ শতাংশ ভোট পান। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের মতে, সেই ভোট স্বচ্ছ ছিল না। ফলে কারচুপির অভিযোগে আন্দোলন শুরু হয়। নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত করা হয়। অথচ ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিশেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে দেশটির পার্লামেন্ট বিশেষ নির্বাচনের মাধ্যমে জোসেলারমে প্রিভেটকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। পরে নতুন করে তফসিল ঘোষণা করে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক সপ্তাহ পর ঘোষণা করা হয়, ময়িজ ৫৫.৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি শপথ নেন। রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয় তখন, যখন বিরোধীদলীয় নেতারা দাবি করে, ২০১৫ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনের তারিখ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদের পর ময়িজ আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। অপরদিকে, ময়িজ ও তার সমর্থকদের দাবি, শপথগ্রহণের তারিখ থেকে হিসাব করে ২০২২ সালে তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে। ময়িজের শাসনামলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীসহ অন্যান্য অনেক শহরে বিক্ষোভ হয়।

ভয়াবহ দুর্নীতি, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে বিতর্কিত হলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ২০১৭ সালে হাইতি ত্যাগ করে। তবে মাত্র চার বছর পর ওয়াশিংটন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবারও সেই অবস্থায় রয়েছে, যেখানে বিদেশি বাহিনী হাইতিতে অভিযানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ফ্যাটন বলেন, ‘রাষ্ট্র নামক বস্তুটি এ মুহূর্তে হাইতিতে অবর্তমান। যে পদ্ধতিতে হাইতিতে কথিত বিদেশি সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেটিই এমনটা হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের সামনে এমন একটি রাষ্ট্র রয়েছে, যা কার্যত গায়েব হয়ে গেছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫