হার্ড ইমিউনিটিতেও থামবে না করোনা, আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২১, ১২:৫৯

প্রতীকী ছবি
এই করোনাভাইরাস মহামারির শেষ কোথায়, জবাবে অনেকেই বলতেন, ধীরে ধীরে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে যাবে। অর্থাৎ একটি বড় গোষ্ঠীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাবে। বেশিরভাগ মানুষের দেহে তখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে, ভাইরাস আর বিস্তারের জন্য যথেষ্ট বাহক পাবে না, তখন মহামারিরও অবসান ঘটবে।
সেই আশা নিভিয়ে দিয়েছে এ ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। বিজ্ঞানীদের একাংশ এখন বলছেন, হার্ড ইমিউনিটি পুরোটাই ‘কাল্পনিক’। পুরো গোষ্ঠী সংক্রমিত হয়ে গেলেও মহামারি থামবে না। করোনার ডেল্টা স্ট্রেনের সংক্রমণ ক্ষমতা দেখেই তা বোঝা গেছে।
এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যের একদল বিশেষজ্ঞ মৃদু উপসর্গ দেখা গেলেই কমিউনিটিতে গণপরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে হাসপাতালে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় আরো বেশি মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ, করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই মানুষকে এখন বাঁচতে শিখতে হবে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকসের অন্তর্গত ভ্যাকসিন গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেন, কোভিড ছড়ানো রুখতে ব্যর্থ ভ্যাকসিন; এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আর হার্ড ইমিউনিটির বিষয়টিও এখন ‘কাল্পনিক তত্ত্ব’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পোলার্ডের নেতৃত্বে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) ব্রিটিশ এমপিদের সামনে তিনি সর্বশেষ গবেষণার তথ্যউপাত্ত তুলে ধরেন।
কোভিড মহামারী বিষয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যের সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপের সামনে তিনি বলেন, ‘আসলে সমস্যা হচ্ছে, এই ভাইরাসটি হাম নয়। কোনো জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ বাসিন্দাকে যদি হামের টিকা দেয়া হয়, ভাইরাস আর ছড়াতে পারবে না। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু এরপরেও ছড়াবে। যারা টিকা পেয়েছে, তাদের শরীরেও ছড়াবে। তার মানে কী... একে থামানোর কোনো পথ নেই!’
তিনি আরো বলেন, যারা টিকা নিয়েছেন, তাদেরও সংক্রমিত করছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। তা মানে হল, যারা টিকা নিচ্ছেন না, কোনো না কোনো সময় তারাও ভাইরাসের শিকার হতে পারেন। আর আমাদের হাতে এমন কিছু নেই, যা এই সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকাতে পারে।
আর ভবিষ্যতে এ ভাইরাসের নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্টও আবির্ভূত হতে পারে, যেটা হয়ত টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে আরো বেশি সক্ষমতা দেখাবে।
তবে কিছুদিন আগেই ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১৮ থেকে ৬৪ বয়সসীমায় যাদের ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে গেছে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ভয় অনেক কম। তুলনায় যারা টিকা নেননি, তাদের করোনা-আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যে কারণে বিশ্বের সব দেশে টিকাকরণে জোর দেয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ-ও বলছেন, যদি সংক্রমিতও হন, টিকা নেয়া থাকলে বাড়াবাড়ি হবে না। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না।
কিন্তু হার্ড ইমিউনিটির ধারণার মূল শর্তই হলো- মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগের শরীরে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও তারা আক্রান্ত হবেন না। কোনো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে কার্যকর ওই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে ভাইরাসও আর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কোনো বাহক খুঁজে পাবে না। আর সেক্ষেত্রে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ, ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে।
তত্ত্বীয়ভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে দুইভাবে। এক- যদি ওই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠেন, এবং প্রাকৃতিকভাবে তাদের শরীরে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ও স্থায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। দুই- যদি টিকা দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীর সবার মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
কিন্তু করোনায় যারা একবার আক্রান্ত হয়েছেন, তারা পরে আবারো আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ, তাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, অথবা করোনার অন্য ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তা কার্যকর নয়।
আবার টিকা দিয়েও সংক্রমণ এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা পুরোপুরি মিলছে না। তাই করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কোনো সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা আর দেখছেন না।
অপরদিকে ছোটদের জন্য ভয় ক্রমে বাড়ছে। বহু দেশেই স্কুল খুলে দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে স্কুল খোলা হচ্ছে। কারণ বড়দের টিকাকরণ হলেও ছোটদের এখনো হয়নি। টিকাহীন অবস্থায় ছোটদের ঝুঁকি বেশি এবং এবারের ঢেউয়ে তারাই আক্রান্ত হবে বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন স্কুল খুলছে; নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে। চিকিৎসক লেনা ওয়েন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডেল্টা সংক্রমণ বাড়ছে। বড়রা নিয়ম মানছেন না, কেউ টিকা নিচ্ছেন না, কেউ মাস্ক পরছেন না। এতে ভাইরাস আরো ছড়াবে, আরো শক্তি বাড়াব। এবং সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ছোটদের।
যুক্তরাষ্ট্রে ১২ বছরের নিচের শিশুরা এখনো টিকা পায়নি। অন্য বহু দেশে ১৮ বছর বয়সীরা টিকা পায়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি খুবই উদ্বেগে রয়েছি। যে সব অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্করা টিকা নিচ্ছেন না, সেখান থেকেই ছোটদের সংক্রমিত হওয়ার খবর আসছে। বড়দের থেকেই তারা আক্রান্ত হচ্ছে।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের এপিডেমিলোজি ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের সাবেক সদস্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডেভিড হেইম্যানের ভাষায়, মানব সমাজে আগে অনেক রোগের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, করোনার ক্ষেত্রেও সেই স্বাভাবিক পরিণতিই হয়ত দেখা যাবে। অনেকটা যক্ষ্মা কিংবা এইচআইভির মতো। আমরা এখন এসবের মাঝেই বসবাস করতে শিখে গেছি এবং এসবের ঝুঁকি কিভাবে যাচাই করতে হয় ও কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয় সেসব আমরা জেনে গেছি।
ডিউক ইউনিভার্সিটি এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথের অধ্যাপক ড. মাইকেল মার্সনও একই ধরনের কথা বলেছেন। তার ধারণা, করোনাও হয়ত ভবিষ্যতে স্থানীয় সংক্রামক রোগে পরিণত হবে, যা জীবনের জন্য ততটা হুমকি হয়ে দেখা দেবে না।