প্যান্ডোরা পেপারস
দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বড় দলিল

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৩:২৩

প্রতীকী ছবি
এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। বিশ্বব্যাপী দেড়শ’ সংবাদমাধ্যমের ছয় শতাধিক সাংবাদিক বছরখানেক ধরে প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ নথিপত্রের ফাইল পরীক্ষা করে ফাঁস করেছেন এই কেলেঙ্কারি। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। গ্রিক পুরাণের প্যান্ডোরার বাক্সের কাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেই এই নাম দেওয়া হয়েছে।
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, প্যান্ডোরা হলেন ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রথম নারী। ঈশ্বর জিউসের নির্দেশে দেবতা হেফাস্টাস তাকে তৈরি করেন। জিউস প্যান্ডোরাকে উপহার দিয়েছিলেন অদম্য কৌতুহল এবং খুব সুন্দর কারুকার্য করা একটি বাক্স। জিউসের কড়া নির্দেশ- এই বাক্সটা যেন না খোলা হয়; কিন্তু অনেক সংযমের পর একদিন কৌতূহলবশত প্যান্ডোরা বাক্সটি খুলে ফেলেন। এরপর কালো ধোঁয়া আর গর্জনে বাক্স থেকে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো বেরিয়ে এল রোগ, লোভ, কষ্ট, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি।
এসব অশুভ বিষয়াদি গ্রাস করল মানবজাতিকে। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের নামে পুঁজিবাদ যে ধ্বংস বয়ে আনছে, এ যেন প্যান্ডোরার ওই বাক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা অশুভবিষয়গুলোর মতোই। পুঁজিবাদের এ যুগে লুটপাট-কেন্দ্রিক অর্থ পাচারকে বিশেষজ্ঞরা সূত্রায়ন করেছেন ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ নামে। আর তাই অফশোর কোম্পানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় এ দলিলের নাম ‘প্যান্ডোরা পেপারস’।
অফশোর ও শেল কোম্পানি
বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের নতুন এক দিক হলো অফশোর, ভুয়া বা কাগুজে কোম্পানি স্থাপন। এসব কোম্পানির অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমেই থাকে, বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ ওই কাগুজে কোম্পানির নামে কোনো অর্থ লেনদেন করাটা অনেক দেশেই বৈধ। এমন কিছু দেশ আছে, যেমন- সামোয়া, বেলিজ, পানামা, ব্রিটিশ ভারজিন আইল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ডস ইত্যাদি- এই দেশগুলোকে ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ দেশ বলা হয়- ঐবধাবহ নয় ঐধাবহ, অর্থাৎ আশ্রয়স্থল। এসব দেশে বিদেশিদের ব্যবসা করতে কর দিতে হয় না, বা অতি সামান্য কর দিতে হয়।
শুধু তা-ই নয়, সেখানকার আইন অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ করা অর্থের উৎসসহ বিভিন্ন তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এ জন্য বিভিন্ন দেশের কালো টাকার মালিকদের কাছে এসব দেশ ‘করস্বর্গে’ পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ধনী ও ক্ষমতাশালীরা সেখানে নিজেদের আত্মীয় বা বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে বিভিন্ন রকম কোম্পানি বা ট্রাস্ট খোলেন। তারপর হুন্ডি বা বিভিন্ন পদ্ধতিতে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে ওই কোম্পানি বা ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার করেন।
প্যান্ডোরা পেপারস তদন্তে ১৪টি ফার্মের নাম এসেছে, যাদের কাজই হলো ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ দেশগুলোতে অর্থ পাচারের জন্য বিভিন্ন দেশের ধনীদের সহায়তা করা। অর্থ পাচারে সহায়তা করে তারা বিশ্বজুড়ে ২৯ হাজার অফশোর কোম্পানি বা ট্রাস্ট খুলতে সাহায্য করেছে। অফশোর সেবাদাতা এসব ফার্ম বিভিন্ন দেশে শেল কোম্পানি গঠন করে গ্রাহকদের পরিচয় গোপন রেখে তাদের আর্থিক লেনদেন করে দেয়। শেল কোম্পানি হচ্ছে একটি বৈধ ব্যবসার খোলস। মূল অর্থের মালিক কে, তা গোপন রাখার পাশাপাশি ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা করাই এ ধরনের কোম্পানির কাজ। আইসিআইজের উদ্যোগে ওই ১৪টি ফার্মের এক কোটি ১৯ লাখ গোপন নথি বিভিন্ন দেশের ১৫০টি সংবাদমাধ্যমের ছয় শতাধিক সাংবাদিক ওই সব নথি বিশ্লেষণ করেন। দুই বছর ধরে তারা নথির উৎস, প্রাসঙ্গিক আদালতের নথি ও অন্যান্য সরকারি তথ্য অনুসন্ধান করেন। কয়েক ডজন দেশে তারা এই অনুসন্ধান চালান।
আইসিআইজে বলছে, এর আগে যে কয়েক দফায় গোপন অর্থ লেনদেনের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তার যে কোনোটির চেয়ে এবার বিভিন্ন দেশের সাবেক-বর্তমান নেতাদের প্রায় তিন গুণ গোপন লেনদেনের তথ্য বের হয়ে এসেছে। অন্তত ১১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই ব্যবস্থার গোপনীয়তার কারণে কার্যত কত সম্পদ এই করস্বর্গের মাধ্যমে পাচার হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে আইসিআইজে।
প্যান্ডোরা পেপারসে গ্রাহকদের গোপন সম্পদ ব্যবস্থাপনায় জড়িত ৯৫৬টি কোম্পানির নথি বিশ্লেষণ করা হয়। ওই কোম্পানিগুলোর দুই তৃতীয়াংশের বেশি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে গঠন করা হয়েছে। এটি হলো ক্যারিবীয় সাগরে ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চল। এসব নথির বেশিরভাগই ১৯৯৬ থেকে ২০২০ সালের। তবে কিছু নথি ১৯৭০-এর দশকেরও রয়েছে। এসব নথিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ৩৩৬ ব্যক্তির গোপন অর্থ ব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে। যাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের পপস্টার, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রনায়ক রয়েছেন। ৯০টি দেশের ৩৫ জন সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্রনায়ক, ৩০০ জনের মতো ক্ষমতাশালী সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, সামরিক কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে এসেছে প্যান্ডোরা পেপারসে।
কর ফাঁকি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে চেক প্রজাতন্ত্রে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রে বাবিস। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তাও দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। এখন জানা গেল, তাদের দুজনেরই বিদেশে কয়েক কোটি ডলারের গোপন সম্পদ রয়েছে। আন্দ্রে বাবিস বেনামে ফ্রান্সের কান শহরের কাছে দুই কোটি ২০ লাখ ডলার দিয়ে প্রাসাদ কিনেছেন। আর কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা বেনামে অন্য দেশে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন।
এই তালিকায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মেকাতি, দুবাইয়ের শাসক মোহাম্মদ বিন রশিদ আলুমাকতুম, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গুইলেরমো লাসো, মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট মিলো জুকানোভিচ, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট লুই আবিনাদের, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরার নামও রয়েছে। আছে শ্রীলঙ্কার সাবেক মন্ত্রী নিরুপমা রাজাপক্ষে ও তাঁর স্বামী থিরুকুমার নাদেসানের নাম। পাকিস্তানের একাধিক মন্ত্রী, ভারতের রিলায়েন্স কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান অনিল আম্বানি, মুকেশ আম্বানিসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক, এমনকি ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকারের নামও রয়েছে এই তালিকায়। বিভিন্ন দেশের মাফিয়ারাও এভাবে তাঁদের অর্থ বিনিয়োগ করছেন। তালিকায় থাকা ১৩০ জনের বেশি ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ারের তালিকায় এসেছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, করস্বর্গের দেশ বা কোম্পানিতে ক্ষমতাবানদের বিনিয়োগের কারণে দেশগুলো বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে। ধনীদের সম্পদ পাচারের ফলে তার বোঝা অবশ্যই পড়ে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির গবেষক লক্ষ্মী কুমার বলেন, ‘সম্পদশালীরা এভাবে পরিচয় গোপন করে অন্য দেশে অর্থ বিনিয়োগ করায় সমাজের বাকি অংশের ওপর তার প্রভাব পড়ে। অর্থ গোপন রাখার সক্ষমতা থাকার মানে হলো আপনার জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়া। আপনার সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও থাকার জায়গার অধিকারের ওপর এর প্রভাব পড়ে।’
আইসিআইজে বলছে, বিশ্বে যখন কর্তৃত্ববাদী শাসন ও অসমতা বাড়ছে, সেই সময় প্যান্ডোরা পেপারস অনুসন্ধান একটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেছে, যা একুশ শতকে অর্থ ও ক্ষমতা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার স্বরূপ উন্মোচন করেছে। আর্থিক গোপনীয়তার নামে কীভাবে বিশ্বজুড়ে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা এখানে উঠে এসেছে। প্যান্ডোরা পেপারসে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকেই অফশোর কোম্পানিতে টাকা আসছে। এই প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা রাখছে অভিজাত প্রতিষ্ঠানসমূহ, বহুজাতিক ব্যাংক, আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠান- যাদের প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে।