ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো বিভক্ত কেন?

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৩৪

ফাইল ছবি
পূর্ব ইউরোপে সামরিক শক্তি মোতায়েনের ঘোষণা দেওয়ার পরদিন ৩০ জানুয়ারি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস বিবিসিকে বলেন, তার দেশ ইউক্রেনে হামলা হলে রাশিয়ার ওপর অবরোধের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যার অধীনে বিভিন্ন রুশ আর্থিক ও জ্বালানি কোম্পানিও থাকবে। রাশিয়ার আগ্রাসনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি মত দেন।
তিনি আরও বলেন, এ কারণেই রুশ হামলা মোকাবেলায় কূটনীতির পাশাপাশি বাধা তৈরি করার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। ‘স্কাই নিউজ’-এর সঙ্গে আরেক সাক্ষাতে তিনি ব্রিটেনে রুশ বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’- এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন রুশ হামলার ব্যাপারে যতটা নিশ্চিত, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেন্সকি ততটা নন। জেলেন্সকির কথায়, রাশিয়া ‘মনস্তাত্বিক চাপ’ প্রয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে আতঙ্ক ছড়াতে মানা করেন। কারণ তা ইউক্রেনের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অপরদিকে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র ফ্রান্স, জার্মানি ও নরওয়ে মনে করছে যে, কূটনীতির মাধ্যমে একটা ছাড় দেওয়ার পদ্ধতি বের হবেই।
একই দিনে রুশ নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান নিকোলাই পাত্রুশেভ ইউক্রেনে রুশ হামলার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, রাশিয়া যুদ্ধ চায় না। রুশ হামলার সম্ভাবনার মুখে পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে মতবিরোধ এখন পরিষ্কার। পশ্চিমাদের মাঝে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনই ইউক্রেনে তাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেবার নির্দেশনা দিয়েছে।
ন্যাটোর মাঝে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের অবস্থান বাকি ইউরোপ থেকে পুরোপুরি আলাদা। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি অত্র অঞ্চলের দেশগুলোতে ভ্রমণ করবেন বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ট্রাসও রাশিয়া এবং ইউক্রেন সফর করবেন।
ব্রিটিশ সরকার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’কে স্বল্প সময়ের নোটিশে মোতায়েন করার জন্য প্রস্তুত রেখেছে। তবে পররাষ্ট্র সচিব ট্রাস বলেছেন, ব্রিটিশ সেনাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারা হামলা মোকাবেলায় ইউক্রেনের ২০ হাজার সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে এবং দেশটার নৌবাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে। এই মুহূর্তে পূর্ব ইউরোপের এস্তোনিয়াতে ৯০০ ব্রিটিশ সেনা, পোল্যান্ডে ১৫০ এবং ইউক্রেনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ১০০ সেনা মোতায়েন রয়েছে।
বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়াতে আর্টিলারি রকেট মোতায়েন ছাড়াও কৃষ্ণ সাগরে দটি যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে ব্রিটেন। রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার আকাশসীমার নিরাপত্তা দিতে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেছেন, পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতি রাখার লক্ষ্যে করা হয়েছে।
ব্রিটেনের মতো একই ধারায় রয়েছে কানাডা। উভয় দেশই আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে। অর্থাৎ ব্রিটেনের মতোই, জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং পশ্চিমা আদর্শকে সমুন্নত রাখাকেই কানাডা প্রাধান্য দিচ্ছে। ইউরোপ বিভাজিত হলেও কানাডায় ইউক্রেনের পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অন্তর্গত কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর লিবারাল সরকার ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা না করলেও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিচ্ছে।
২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ঘোষণা দেন, ইউক্রেনে ‘অপারেশন ইউনিফাইয়ার’-এর অধীনে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ২০০ কানাডীয় সেনার সঙ্গে আরও ৬০ জন অতি শিগগির যোগ দিচ্ছে। তিনি তার মন্ত্রিসভার সঙ্গে বৈঠকের পর বলেন, সৈন্যসংখ্যা ৪০০ পর্যন্ত যেতে পারে। কানাডার সরকার ইউক্রেনকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মেটাল ডিটেক্টর, থার্মাল বাইনোকুলার, লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার, সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি এবং মেডিকেল সরঞ্জাম দিচ্ছে। এ ছাড়াও কানাডার ইলেকট্রনিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘কমিউনিকেশন্স সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্ট’ ইউক্রেনের ইলেকট্রনিক এবং সাইবার নিরাপত্তায় সহায়তা দিচ্ছে। এই সহায়তাগুলোর মূল্যমান প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়াও কানাডা ইউক্রেনকে ৩৯ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা এবং ৯৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়া ছাড়াও কূটনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করেছে।
কানাডার ‘সিবিসি নিউজ’ বলেছে, এ পর্যন্ত ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ছাড়াও ছোট্ট বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে। বিরোধী কনজারভেটিভ দল ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। তারা আরও চাইছেন, ২০১৪ সাল থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের সরকার ইউক্রেনকে স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে যে সহায়তা দিচ্ছিল, তা আবারও চালু করা হোক। কানাডায় বসবাসরত ১৩ লক্ষ ইউক্রেনিয়ানের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ‘ইউক্রেনিয়ান ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস’ও ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য লবিং করছে।
ইউক্রেন উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে কথা বলবেন। উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। জার্মানি রুশ গ্যাসের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল থাকায় তারা ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের কথা বললেও, ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেবার পক্ষপাতি নয়। যেখানে ব্রিটেন ও কানাডা পশ্চিমা আদর্শিক লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে, সেখানে জার্মানি তার জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে এগুতে চাইছে না।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাতে ন্যাটোর প্রত্যুত্তরকে ‘আদর্শ দ্বারা প্ররোচিত’ বলে আখ্যা দেন। ল্যাভরভ মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডার আদর্শিক অবস্থানকে লক্ষ্য করেই কথাগুলো বলেছেন। শুধু পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার সীমান্তে ছোট্ট দেশগুলোই এদের সঙ্গে রয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো বড় ইউরোপিয় শক্তিরা সরাসরি নিজেদেরকে জড়াতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন পশ্চিমা আদর্শকে কাবুল বিমান বন্দরে রেখে এসেছে, তখন ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
ব্রিটেনও বলছে যে, তারাও ইউক্রেনে সরাসরি যুদ্ধ করবে না। তথাপি ইউক্রেন সীমান্তে পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ ও কানাডাকেই যেন নিতে হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মানা করছেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে সামরিক সহায়তা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ ইউক্রেনকে রক্ষা নয়, বরং ইউক্রেনের ধ্বংসস্তূপের মাঝেই পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব পালন করবে।