সেনাশাসনে মিয়ানমার
দমন-নির্যাতন-আন্দোলনের এক বছর

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৩৫

ছবি: সংগৃহীত
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়েছিল মিয়ানমারের ভোটে নির্বাচিত সরকার। এই এক বছরে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন লাখো মানুষ। অনেকে গুম-খুন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা সামরিক আদেশ অমান্য করেছেন। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে দুটি শহরে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত দুই চিত্র- একদিকে ইয়াঙ্গুন, সেখানে সেনাবিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতালে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বের হননি কেউ; অপরদিকে সেনানিয়ন্ত্রিত রাজধানী নেপিদো- সেখানে মোড়ে মোড়ে সেনা-সমর্থিত দল সরকারের পক্ষে মিছিল করেছে। সামরিক বাহিনী বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সামরিক নির্যাতন ও আন্দোলনে গোটা বছর উত্তাল থাকলেও, শিগগিরই কোনো সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না।
২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। জয় পান অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ তুলে অভ্যুত্থান করে সামরিক বাহিনী। আটক করা হয় রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের। সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং হন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা।
অভ্যুত্থানের পরপরই এনএলডির দলীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে নথিপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করে নিয়ে যায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অং সান সু চির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ভাঙার অভিযোগ আনে সামরিক জান্তা সরকার। এ ছাড়াও সু চির বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন মামলা করা হয়। কয়েকটি মামলার রায়ও হয়েছে এরই মধ্যে। সামরিক আদালতে চলছে সু চির বিচার। একাধিক ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। ফলে ১৫০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে সু চির!
সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ২০০৭ সালের পর সেনাবিরোধী সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ শুরু হয় মিয়ানমারজুড়ে। অভ্যুত্থানবিরোধী স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন শত শত বিক্ষোভকারী। সে সময় টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে দেয় জান্তা সরকার। এমনকি ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত এক বছরে, বিক্ষোভকারীরা অহিংসভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একাধিক কর্মসূচি সংগঠিত করেছেন। সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী এবং একাধিক পরিষেবার কর্মীদের হরতালে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এর আগে সর্বশেষ দেশব্যাপী ধর্মঘট হয়েছিল গত ডিসেম্বরে। মিয়ানমারজুড়ে শহর ও শহরতলি ছিল একেবারে ফাঁকা। আর ইয়াঙ্গনের বিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডার সামনেও মানুষজন ছিল না।
হরতালে অংশ নিলে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দিয়েছিল জান্তা সরকার। প্রতিবাদ জানালে কিংবা সেনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো মিছিল, সমাবেশ বা প্রচার করলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়েরের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এরপরও ইয়াঙ্গুনের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা স্ট্র্যান্ড রোড ছিল জনশূন্য। সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। অ্যাক্টিভিস্টদের কথায়, এটি ছিল ‘নীরব হরতাল’। গ্রেফতারের হুমকিকে পরোয়া করেননি অনেক প্রতিবাদী। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল গণতন্ত্রপন্থী ব্যানার। তাতে লেখা ছিল, ‘জনগণের ইচ্ছার বিরোধিতা করার স্পর্ধা দেখায় কে’।
অপরদিকে, মিয়ানমারের স্টেট নিউজ সার্ভিস জানিয়েছে, রাজধানী নেপিদোতে ১ ফেব্রুয়ারি সেনাশাসকদের সমর্থনে সমাবেশ হয়েছিল। সেনা-সমর্থিত দল মিছিলও করেছে। তবে সেখানেও ছিল সেনা বাহিনীর নিরাপত্তা। সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে মিন অং হ্লাইং দাবি করেছেন, ২০২০ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। এর আগের দিন (৩১ জানুয়ারি) জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি।
এ দিকে সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সহিংসতার অভিযোগে নতুন করে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সিইসি এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সহিংসতার অভিযোগে সাত ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশগুলো।
তবে নিষেধাজ্ঞার পরও সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দৈনিক সংঘাতের মাত্রা কমার কোনো আলামত দেখা যায়নি। বিভিন্ন জায়গায় সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও স্থল মাইন হামলা চালানো হচ্ছে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছায়া সরকারের আইনপ্রণেতারা দাবি করেছেন, গত বছরের জুন থেকে নভেম্বরে ছায়া সরকারের সামরিক শাখা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় তিন হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। অপর দিকে জান্তা সরকার বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসি বলেন, ‘এক বছরের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপরও প্রভাব পড়েছে। সেনাবাহিনী এখন মনোবল ও নিয়োগ সংকটের মধ্যে আছে।’ তবে এসব চ্যালেঞ্জের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়বে বলে মনে করেন না হোরসি।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সমূলে বিনাশের চেষ্টা করেছে। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে অহিংস বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেনা বাহিনী। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের এক বছরে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, তারা সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যুর রিপোর্ট খতিয়ে দেখছে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয়, এই মৃত্যুটিই প্রথম নথিভুক্ত হয়েছিল। মিয়ানমারের তিন লাখ সদস্যের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা কিছু মানুষ। বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ রয়েছেন সেখানে। তাই তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের নাম দিয়েছেন পিপল ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। পিডিএফের সশস্ত্র সংগ্রামের অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র জাতিগত সংগঠন কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ)। কারেন প্রদেশে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে আশ্রয় দিয়েছে তারা। পিডিএফ সদস্যদের জঙ্গলে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে কেএনইউ।
এক বছর পরও ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা। প্রতিদিনই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা।