ক্ষুদ্র দেশ কাতারের বড় কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী?

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:১০

ছবি: সংগৃহীত
গত ২৭ জানুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাতার ও তুরস্ক আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের সঙ্গে কাবুল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে।
এর চার দিন পর ৩১ জানুয়ারি কাতার বলে, তাদের সঙ্গে তালেবান সরকারের এক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে যারা চলে যেতে চায়, তাদের জন্য নতুন করে কাতার এয়ারওয়াজের চার্টার করা বিমানের ফ্লাইট চালু করা হবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনিদের পলায়নের পর থেকে কয়েক মাস ধরে তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় এই ফ্লাইট বন্ধ ছিল। এই চুক্তির ফলে আফগানিস্তানে আটকে পড়া হাজারো পশ্চিমা নাগরিক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে সহায়তা দেওয়া হাজারো আফগানদেরকে দেশ থেকে সরিয়ে ফেলা যাবে। কাতারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি ওয়াশিংটনে মার্কিন মিডিয়া ‘এক্সিওস’এর সঙ্গে এক সাক্ষাতে এই কথাগুলো প্রকাশ করেন।
উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে ওয়াশিংটন সফর করছিলেন। শেখ তামিম হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সময়ে ওয়াশিংটন সফর করা মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম নেতা। সফরকালে বাইডেন কাতারকে ন্যাটোর বাইরে ১৭টি প্রধান মিত্র দেশের মাঝে একটি বলে ঘোষণা দেন। ‘আল মনিটর’ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে কাতারের বড় ভূমিকার জন্যই প্রেসিডেন্ট বাইডেন কাতারকে এই সন্মাননা দিয়েছেন। এর মাঝে কাতারের সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নের সময় দোহার সমর্থন। মার্কিনীদের সঙ্গে তালেবানদের আলোচনার মূল মাধ্যমই ছিল কাতার। নিজেদের আকারের তুলনায় কাতারের বিশাল কূটনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে দেশটা নাম সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক আলোচনায় উঠে আসছে।
গত ২২ জানুয়ারি বার্তাসংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছে, বাইডেন শেখ তামিমকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই আমন্ত্রণের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা হলে পশ্চিমা অবরোধের মুখে রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রফতানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের জ্বালানি সমস্যাকে কীভাবে মোকাবেলা করবে। কাতার হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি। তবে দেশটার বেশিরভাগ এলএনজিই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রফতানি হয়ে থাকে। অপরদিকে ইইউএর দেশগুলো তাদের ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল; যে কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপের দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্রিত করতে পারছে না।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’- এর এক লেখায় ‘কাতার ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর নিকোলে কোজানভ বলেছেন, বাইডেনের ও তামিমের পরিকল্পনা সফল হলে কাতার ইউরোপের গ্যাসের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে; যার ফলশ্রুতিতে কাতার অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করতে পারবে। ২০২১ সালের শেষের দিকে ব্রিটেনের জ্বালানি সংকটের সময় কাতার পূর্ব এশিয়ায় এলএনজি পাঠানো স্থগিত করে ব্রিটেনকে সহায়তা দেয়। ফলে ব্রিটেন কাতারকে সন্মাননা জানিয়ে ‘দুর্যোগের সময়ের সরবরাহকারী’ বলে আখ্যা দেয় এবং একটা গোপন চুক্তি করে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাতারের সখ্যতা বাড়লে তা কাতারকে বাড়তি নিরাপত্তা দেবে। প্রায় তিন বছর ধরে কাতারকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অবরোধ দিয়ে রেখেছিল; যা কি-না কাতারকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট করতে অনুপ্রাণিত করবে।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রধান সামরিক ঘাঁটি সৌদি আরবের ‘প্রিন্স সুলতান এয়ার বেইস’ থেকে কাতারের আল উদাইদ বিমান ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই ঘাঁটি দেওয়ার মাধ্যমে কাতার তার বড় প্রতিবেশী সৌদি আরব থেকে নিজেকে রক্ষা করে। তবে কাতারের এই চিন্তা নতুন নয়। ঊনিশ শতক থেকেই কাতারের আল থানি পরিবার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আগ্রাসন থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে ব্রিটেনকে আলিঙ্গন করে। ১৯১৬ থেকে কাতারের নিরাপত্তা ছিল ব্রিটেনের হাতে। ১৯৭১ সালে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে কাতারের ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। সে সময় থেকে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবসময়ই ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে কাতার। মাত্র ৩ লাখ জনগণের কাতারের পক্ষে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ একটা অবাস্তব চিন্তাই বটে। সামরিক বাহিনী এবং সরকারি বহু কাজে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে কাতার। দেশটিতে ২৩ লাখ মানুষের বিশাল এক বিদেশি কর্মী দল কাজ করে, যারা সে দেশের নাগরিকদেরকে সংখ্যালঘিষ্ঠ করে ফেলেছে।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’- এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, নিজের নিরাপত্তাহীনতাকে কাটাতেই কাতার বাস্তবতাকে পুঁজি করে তার কূটনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রাধান্য দিয়েছে; যাতে করে পশ্চিমাদের কাছে কাতারের গুরুত্ব অনেক বেশি থাকে। এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতে কাতার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন, কাতার তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে। তবে কাতার জঙ্গীগোষ্ঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পেরেছে। উদাহরণ হিসেবে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় কাতারের মধ্যস্থতা উল্লেখযোগ্য।
অতি ক্ষুদ্র কাতারকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে ব্রিটেন একটা পশ্চিমা নির্ভরশীল রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছিল। এখনো দেশটির বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা কাজ করছে। ব্রিটেনে কাতারের বিশাল বিনিয়োগও রয়েছে। ছোট্ট দেশটির ওপর অপর পশ্চিমা বন্ধু সৌদি আরবের হুমকির কারণে কাতার সর্বদাই পশ্চিমা সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এলএনজি রফতানি করে অর্জিত বিপুল অর্থ পশ্চিমা অস্ত্র কেনায় ব্যবহৃত হলেও, সেগুলো চালনা করার মতো জনবল কাতারের নেই। স্বল্প জনসংখ্যার কারণে কাতারকে তার সামরিক এবং সরকারি জনবলের অনেকটাই বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়।
আবার কাতারের বিশাল হাইড্রোকার্বন সম্পদকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে। ইউরোপে কাতারের এলএনজি সরবরাহ করে রুশ গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করার বাইডেনের পরিকল্পনাও এরই অংশ। ছোট্ট কাতারের বিরাট আকারের কূটনৈতিক কর্মকান্ডও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে। তবে অর্ধশতাব্দী আগে সুক্ষ্ম ব্রিটিশ পরিকল্পনায় তৈরি কাতারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ ব্রিটেনেরও প্রভাব বৃদ্ধি।