Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ধেয়ে আসছে!

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২২, ১৫:৫৩

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ধেয়ে আসছে!

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০১১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ১০ মার্চ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন কৃষি দপ্তরের হিসাবে, রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রফতানিকারক দেশ; ইউক্রেন হলো এক্ষেত্রে চতুর্থ।

‘ওআইসি’র হিসেবে ২০১৯ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে বিশ্বের মোট রফতানিকৃত গমের সাড়ে ২৫ শতাংশ সরবরাহ করেছিল। আর এই দুই দেশ গোটা বিশ্বের গম ও বার্লি রফতানি বাজারের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে থাকে। ইউক্রেন ভুট্টা এবং সূর্যমুখী তেলেরও বড় জোগানদাতা। এছাড়াও এই দুই দেশ বিশ্বের রাসায়নিক সারের একটা বড় উৎস। যুদ্ধটা যেভাবেই শেষ হোক না কেন, করোনা মহামারির ঠিক পরেই এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বহু দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ‘কমিটি অন ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি’র প্রধান গ্যাব্রিয়েল ফেরেরো ডে লোমা ওসোরিও ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলেছেন, করোনা আসার আগেই বিশ্বে ৬৬ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যাভাবের মধ্যে ছিল। করোনার পর এটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটিতে। 

ইউক্রেনের অনেক বন্দরেই অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; আজভ সাগর অঞ্চলে জাহাজ চলাচলই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উসতেনকো ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’- এর এক লেখায় বলেছেন, ইউক্রেনে গম চাষ শুরুর সময় হলো মার্চের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে; আর গমের চারা রোপণ শেষ করতে হবে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের আগেই। যুদ্ধের জন্য যেহেতু মার্চের অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে, তাই স্বাভাবিক হিসেবে গমের চাষ এ বছরে আর সম্ভব হবে না। গম চাষে স চেয়ে উপযোগী অঞ্চলগুলোতেই এখন যুদ্ধ চলছে। আর অদূর ভবিষ্যতে মাইন ও অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ না সরিয়ে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করা যাবে না। 

জাতিসংঘের ডে লোমা ওসোরিও আরও বলেছেন, বাংলাদেশ তাদের মোট গম আমদানির অর্ধেকই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আনতো। তবে ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে, এর চেয়েও বড় হুমকির মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো, যারা মূলত কৃষ্ণ সাগরের অপেক্ষাকৃত কম দামি খাদ্যশস্যের ওপরেই নির্ভর করেছে এতোদিন।

অত্র অঞ্চলের লেবানন, মিশর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন ও সুদানের মতো দেশগুলোতে গম থেকে তৈরি খাদ্যই প্রধান খাদ্য। এই দেশগুলো আরও আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি, অর্থসংকট এবং সংঘাতের কারণে খাদ্যঘাটতির মধ্যে ছিল। লেবাননের কর্মকর্তারা ধারণা করেছেন, তাদের গমের মজুত খুব বেশি হলে, একমাস টিকবে। দেশটার ৬০ শতাংশ গম আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বৈরুতের রাস্তায় অনেকেই রুটির জন্য আটা মজুত করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য খাবার তৈরি ও বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। বৈরুতের এক গবেষণা সংস্থার প্রধান রিয়াদ সাদে মনে করেছেন যে, এমন একটা সময় চলে এসেছে, যখন মানুষ রুটির জন্য বিদ্রোহ করতে পারে। অপরদিকে ইয়েমেন তাদের চাহিদার ৯০ শতাংশ গমই আমদানি করে; তাই সেখানে মারাত্মক দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধ ও খরার কারণে দেশটিতে দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে কয়েক বছর ধরে। সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘের হিসাবে ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। 

জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’- এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড বীসলি বলেছেন, অর্থাভাবে তারা সিরিয়াতে ৮০ লাখ মানুষের জন্য খাবার রেশন অর্ধেক করেছেন; আরও কমানো হবে। ঠিক ওই মুহূর্তেই ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলো। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে তারা তাদের অর্ধেক গমের সরবরাহ আসতো। 

মিশরে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১- এর ডিসেম্বরের মধ্যে সেখানে ৮০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে গমের মূল্য ৫০ শতাংশ বেড়েছে। মিশর হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম আমদানিকারক দেশ। ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল’- এর হিসেবে গত জানুয়ারিতে মিশর ৩৫ লাখ টন গম কিনেছে। তাদের ৮০ শতাংশ গমই ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে এসেছে। দেশটির হাতে এই মুহুর্তে ৪ মাসের গম মজুদ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট সিসির সরকার ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা রুটির ওপর ভর্তুকি কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। অবস্থাটা মিশরের অর্থনীতির জন্য অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে বলেছেন ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’- এর অর্থনীতিবিদ মাইকেল টানচুম। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তুরস্কে খাবার তেলের মূল্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে; আর জনগণ সূর্যমুখী তেল মজুদ করতে শুরু করেছে। যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে তুরস্কের ৭০ শতাংশ খাবার তেল আসে। 

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলেছে, তিউনিসিয়ার প্রায় অর্ধেক আমদানিকৃত গম আসে ইউক্রেন থেকে। গমের মূল্য সেখানে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। সে দেশে সরকার রুটির মূল্য নির্ধারণ করলেও, সকলেই মনে করছেন যে, তাদের জীবনের ওপর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বেই। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণের বোঝার কারণে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি আরও আগ থেকেই ধুঁকে চলছিল। 

‘ডব্লিউএফপি’র মুখপাত্র আবীর এতেফা বলেছেন, এ বছরে বিশ্বে চাহিদার চেয়ে বেশি গম উৎপাদন হয়েছে; কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে যেখান থেকে গম আসতে হবে, তাতে সময় এবং পরিবহন খরচ উভয়ের ওপরেই চাপ পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল বহু দিন ধরেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; যার মূলেই রয়েছে ধসে পড়া অর্থনীতি; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। 

এতেফা বলেছেন, খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হলে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা এবং সহিংসতার আশংকা বৃদ্ধি পাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘাতের সৃষ্টি করছে। 

মাইকেল টানচুম মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলো মিশরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পাওে; কিন্তু তিনি একইসঙ্গে মিশরের নিজস্ব কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বই যখন করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মিশরসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষাকর্তা হবার ধারণাটা অবাস্তবই বটে। বাম্পার ফলনের বছরেও কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে থাকছে, তখন তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশ্বিক বন্টন ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫