সায়াদ খোদাইয়ের মৃত্যুতে সড়কে নেমে শোক জানান ইরানের জনগণ। ছবি- রয়টার্স
২০২০ সালের এক দুপুরে তেহরানের রাস্তা দিয়ে গাড়ি বহর নিয়ে যাচ্ছিলেন ইরানের সবচেয়ে নামকরা পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেহ। হঠাৎ তার গাড়িটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান এই পরমাণুবিদ। ইরান হারায় তার জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে। এজন্যে তারা দায়ী করে ইসরায়েলকে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এই কিলিং মিশনের জেরে ওই সময়েই ব্যাপক আলোচিত হয় দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। এমনকি এও বলা হয় যে খোমেনির দেশের অনেক গভীরে রয়েছে শত্রু দেশের বিচরণ।
শুধু এই ঘটনা নয়। এর আগেও নানাভাবে ইরানে ঢুকে সফল কিলিং মিশন চালিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু চিরশত্রুর দেশে ঢুকে কীভাবে সফল হয় তেল আবিব!
ইরানের কর্মকর্তাদের দাবি দেশের ভেতরেই রয়েছে শত্রু পক্ষের লোক। যে কারণে কঠোর নিরাপত্তা বলয়েও অসহায় মৃত্যু ঘটে দেশটির পদস্থ কর্মকর্তাদের।
২০২০ সালে মোহসেন ফখরিযাদেহ হত্যার ঘটনার পরে ইরান জানিয়েছিল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত একটি মেশিনগান দিয়ে এই হামলা চালানো হয়।

এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের নিরাপত্তা গোয়েন্দামন্ত্রী মাহমুদ আলাভি দাবি করেছিলেন, ঠিক যে জায়গায় ফখরিযাদেহর ওপর গুলি চালানো হয়েছিল, সেখানেই যে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, সেটির ব্যাপারে তিনি দুই মাস আগেই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
আলভি আরো বলেছিলেন, যে ব্যক্তি এই হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন, তিনি ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্য। আলভির এ দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে এই ব্যক্তি আইআরজিসির এত উচ্চপদে ছিল যে, তার পক্ষে হামলার সতর্কসংকেত নাকচ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। যে কারণে সাধারণ নিরাপত্তায় চলাফেরা করে আসছিলেন মোহসেন!
পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেহকে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট তারিখের নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত স্থানেই হত্যা করা হয়। মোহসেন ফখরিযাদেহ নিজেও আইআরজিসির একজন সদস্য ছিলেন।
ইরানের আইআরজিসির যে শাখাটি বিদেশে তৎপরতা চালায়, সেটির নাম 'কুদস ফোর্স।' এটির একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদেশি গুপ্ত সংস্থাগুলোর কাছে ইরানের কয়েকজন রাষ্ট্রদূত এবং আইআরজিসি কমান্ডের ব্যাপারে অনেক তথ্য আছে।
কর্নেল খোদাই রেভল্যুশনারি গার্ডের ছায়া বৈদেশিক শাখা কুদস বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য। কুদস বাহিনী মূলত বিদেশে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়ে থাকে। ফলে তার ওপরে ইসরায়েলের নজর ছিল বহুদিন ধরেই। যার বাস্তবায়ন হল চলতি বছরের গত ২৩ মে।
এ যেন মোহসেন ফখরিযাদেহর ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০২০ সালের ফখরিযাদেহর মতাই তেহরানে নিজ বাড়ির সামনে গাড়িতে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্নেল সায়াদ খোদাই।
মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্দুকধারী তাঁর গাড়িতে গুলি করে পালিয়ে যায়। গাড়িটিতে পাঁচবার গুলি ছোড়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, একটি গাড়িতে রক্তাক্ত অবস্থায় খোদাইয়ের মৃতদেহ পড়ে আছে। তাঁর গায়ে তখনো সিটবেল্ট লাগানো।
ফখরিযাদেহর ঘটনার দুই বছর আগে ২০১৮ সালে ইরানের নিরাপত্তার বেহাল দশার এক বড় তথ্য ফাঁস হয়। সেবছরের জানুয়ারিতে রাজধানী তেহরান থেকে ২০ মাইল দূরে একটি গুদাম থেকে পরমাণু কর্মসূচিবিষয়ক আধা টন গোপন দলিল চুরির ঘটনা ঘটেছিল।

পরে ইসরায়েরলের তৎকালীন নেতা নেতানিয়াহু ২০১৮ সালের এপ্রিলে এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চুরি করে আনা এসব দলিল তুলে ধরেন। সেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, ইরানের একটি অঘোষিত পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি আছে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেহ। এর দুই বছর পরেই তাকে হত্যা করা হয়।
এদিকে ২০২০ সালের পর এটিই ইরানে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সম্পাদক সেবাস্তিয়ান আশার।
সায়াদ খোদাই হত্যার ঘটনার পরেও যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের ইঙ্গিত করে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইদ খতিবজাদেহ বলেছেন, ইরানের শত্রুরাই কর্নেল খোদাইকে হত্যা করেছে। বিশ্বের দাম্ভিক দেশগুলোর সহযোগী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এ কাজ করেছে।
এবার বেরিয়ে এলো বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কর্নেল হাসান সাইয়্যাদ খোদায়ি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের শক্তির কথা।
মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে এই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে ইসরায়েল। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস আজ শুক্রবার (২৭ মে) এ খবর জানিয়েছে। খবর ডনের।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েল জানিয়েছে, এই গুপ্তহত্যা ইরানের প্রতি একটি সতর্কবার্তা, যাতে ইরানের অভিজাত কুদস ফোর্সের অভিযান বন্ধ করা হয়। এই বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন খোদায়ি।
এসব ঘটনার জেরে মূলত ইরানের ভেতরের দুর্বল নিরাপত্তার চিত্রই যেন ফের প্রকাশ পেল।
২০২০ সালে ইরাকে বিমান হামলায় ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হন। কুদস বাহিনীর প্রধান হিসেবে ইরানের সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
যদিও এসব ঘটনায় ইরান সেভাবে শক্ত কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তবে বারবারই ইরানের ভেতরে ঢুকে সফল কিলিং মিশন চালাতে পেরেছে ইসরায়েল।