Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

অশান্ত অঞ্চলে সহিংসতা দমনে ব্যর্থ পাকিস্তান

Icon

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ১৮:৫৪

অশান্ত অঞ্চলে সহিংসতা দমনে ব্যর্থ পাকিস্তান

পাকিস্তানের পতাকা।

খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপিকে) ও বেলুচিস্তান অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ নির্মূলে ২০১৭ সালে অপারেশন রাদ-ইউআই-ফাসাদ (আরইউএফ) ঘোষণা করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই অঞ্চলগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও অভিযানকে সফল দাবি করে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে উঠেছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর মিডিয়া উইং আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানায়, অপারেশন রাদ-ইউআই-ফাসাদ (আরইউএফ) সমাপ্ত করা হয়েছে। দুই দশক-ব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই অভিযানটিকে একটি বড় সাফল্য বলে দাবি করে সংস্থাটি।

২০১৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানের অশান্ত এলাকাগুলোকে লক্ষ্য করে আরইউএফ অভিযান চালু করে। তবে গত ৫ বছরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা বরং বৃদ্ধিই পেয়েছে।

অভিযান শেষ ঘোষণা করা হলেও পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর প্রায় নিয়মিত হামলা চলছে। ফলে নতুন করে সরকারকে আরও রক্ষী মোতায়েন করতে হচ্ছে।

আরইউএফ অভিযানের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর লুকিয়ে থাকা গোষ্ঠী বা 'স্লিপার সেল' নির্মূল করা। তবে অভিযানের যে সফলতা দাবি করা হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো দেশটিতে সন্ত্রাসবাদের হুমকি রয়েছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত দশক পরেও বেলুচিস্তান, এফএটিএ/কেপিকে, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সরকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। এরমধ্যে বেলুচিস্তান ও কেপিকে এলাকায় স্থানীয় জাতির নেতারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

আরইউএফ অভিযানের পাঁচ বছর পরেও নিরাপত্তা বাহিনী কেপিকে ও বেলুচিস্তানের অশান্ত এলাকায় হতাহতের শিকার হচ্ছে। শুধু ২০২১ সালেই ৪৬৬টি ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৪১ জন সদস্য নিহত ও ২৮৫ জন আহত হয়েছেন।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৫২টি ঘটনায় ৩২৩ জন নিরাপত্তা রক্ষী নিহত ও ১৮৬ জন আহত হয়েছেন। ফলে বলা যায় এই বছরে হতাহতের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাঁচ বছরে পাক সেনাদের চলমান অভিযানে সন্ত্রাসবাদীরা দুর্বল হওয়ার বদলে বেলুচিস্তান ও কেপিকের মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর নতুন নতুন কৌশল বের করতে পেরেছে। সম্প্রতি যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতে এটাও স্পষ্ট যে মুক্তিযোদ্ধারা আরও ভালো অস্ত্র ও কৌশলে লড়াই করছে।

আগে একক হামলার ঘটনা ঘটতো। যেখানে গুলি করে, গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, হামলা চালিয়ে হামলাকারী পালিয়ে যেতো। সেখানে এখন তারা নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর সমন্বিত আক্রমণ চালাচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমনই এক হামলার পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এই হামলার ঘটনায় বিস্মিত হয়ে যান পাক কর্মকর্তারা। পরে পাক প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান ওই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

পাক সেনাবাহিনীর ১১ কোর (অগ্রসৈনিকসহ) কেপিকে এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে। সেনারা নিয়মিত ওই এলাকায় যাতায়াত করলেও স্থানীয় যোদ্ধাদের তারা দমাতে পারেনি। এছাড়া ডুরান্ড লাইনে নিয়মিত সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে পরিস্থিতি নাজুক রয়েছে।

বেলুচিস্তানে (উত্তর ও দক্ষিণ) নিরাপত্তা ও অভিযান চালাতে ১২ কোরের অধীনে দুটি পদাতিক ডিভিশন মোতায়েন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর। এতে সমন্বয়ের জন্যে গোয়াদরে ৪৪ ইনফ. ডিভিশনও মোতায়েন করা হয়েছে। এতো সেনা থাকা স্বত্বেও স্থানীয় যোদ্ধাদের কৌশলের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছে পাক সেনাবাহিনী। যে কারণে ওই এলাকার পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ।

প্রকৃতপক্ষে চলতি বছরে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী সবসময়ই নিজেদের সেনা হারানোর খবর কিছুটা হলেও কমিয়ে উল্লেখ করে থাকে। ফলে বলা যায়, আরইউএফ চূড়ান্তভাবেই সফল একটি অভিযান ছিল।

এই অভিযানে আরেকটি বিষয় সামনে উঠে এসেছে। স্থানীয় জনগণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশে থাকলেও সেনাবাহিনীকে সেভাবে সহযোগিতা করেনি। যে কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালিয়ে মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পেরেছে। সাধারণত কোন এলাকায় যুদ্ধে ওই এলাকার স্থানীয় সৈনিকদের মোতায়েন করা হয়। তবে ওই এলাকায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পাক বাহিনী আগেই অন্য প্রদেশের সৈনিকদের মোতায়েন করেছিলো। ফলে তারা এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার অভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। অন্যদিকে নির্বিচারে হামলা চালানোয় সমালোচনার শিকারও হতে হয়েছে পাক বাহিনীকে।

এমনকি এই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিদের ওপরেও নির্মমভাবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। যা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘনও। বেসামরিক মানুষের ওপরে হামলার কারণে সেনাবাহিনী জনবিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েছে।

কেপিকে ও বেলুচিস্তানের জনগণের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈরি আচরণ ওই অঞ্চলে সহিংসতার অন্যতম কারণ। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে পাঞ্জাবিরা জাতীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে। অন্যান্য প্রদেশ থেকে আয় আসলেও জাতীয় সম্পদ ও উন্নয়নের একটি অসম পরিমাণে বেশি অংশ উপভোগ করেছে পাঞ্জাবিরা। কেপিকে অঞ্চলের প্রায় ৫০ ভাগ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। সেখানে শাসন ব্যবস্থা না থাকা ও অস্তিত্বহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও হয়নি। ফলে বেকার যুবকরা জঙ্গি সংগঠনের দিকে ঝুঁকছেন।

একই অবস্থা বেলুচিস্তানেও। এই অঞ্চলের মানুষেরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে। বৃহত্তম প্রদেশ ও বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের সরবরাহকারী হলেও এই রাজ্য জাতীয় উন্নয়নের মাত্র ৯% পায়। যেখানে পাঞ্জাবিরা একাই পায় ৫০% প্রকল্প। এই বৈষম্যের কারণে বঞ্চিত বেলুচরা স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহত ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় উদাসীন চিন্তার কারণে আরইউএফ পাকিস্তানে একটি বিতর্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় জনগণের সমর্থন ছাড়া একটি বিদ্রোহ বিকাশ পায় না। কয়েক দশক ধরে পাক বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তারা জনগণের থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় টেকসই চিন্তা না থাকায় সেনা যুদ্ধের যে প্রকল্প নিয়েছে পাক সরকার। তা চূড়ান্ত ব্যর্থ বলেই প্রকাশ পেয়েছে। আরইউএফের মতো অভিযান তাই ব্যর্থ হওয়ারই ছিল।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫