Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে বিভক্ত ইউরোপ

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ১৪:৫১

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে বিভক্ত ইউরোপ

যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে। ফাইল ছবি

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সাড়ে তিন মাস পর পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার ব্যাপারে একমত হতে পারছে না। যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে যতটা ঐক্য প্রদর্শন করেছিল, যুদ্ধ লম্বা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিন্তাগুলো ততটাই অনৈক্যে রূপ নিচ্ছে। 

বার্লিনের ‘রবার্ট বশ একাডেমি’র ফেলো এবং ‘লে মন্ড’ পত্রিকার কলামিস্ট সিলভি কাউফম্যান ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-এর এক লেখায় বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে শেষ হওয়া উচিত, তা নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। প্রথম গ্রুপটা মনে করছে, রাশিয়াকে এমনভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত, যাতে করে সে আর এ ধরনের কাজ না করে। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করার সময়ে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার সময়ে পশ্চিমারা যদি যথেষ্ট শক্তভাবে বাধা দিত, তাহলে রাশিয়া হয়তো ২০২২ সালের কাজটা করতে সাহস পেত না। ২৫ এপ্রিল মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেছেন, রাশিয়াকে যথেষ্ট ‘দুর্বল’ করে ফেলা উচিত। তবে এই কথার সঙ্গে ওয়াশিংটনের লক্ষ্যের সম্পর্ক কতটুকু, তা এখনো যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।

অপরদিকে দ্বিতীয় গ্রুপটা মনে করছে যে, যুদ্ধ শেষ হওয়া উচিত ইউক্রেনের জয় দিয়ে। আর ইউক্রেনের সীমানা নিয়ে সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকেই নিতে দেওয়া উচিত। ইউরোপের অনেকেই ভোলেনি কীভাবে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে ভাগাভাগি করেছিল; যা কিনা পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। আর এই দেশগুলোই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও মধ্য ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দেয়। 

ব্রিটেনের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক কন কাফলিন কিছু ন্যাটো সদস্য দেশের মারাত্মক সমালোচনা করছেন। তিনি বলছেন, জার্মানি ও ফ্রান্স ইউক্রেনকে রক্ষা করার চেয়ে রাশিয়াকে তুষ্ট করাতেই বেশি আগ্রহী। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো পশ্চিমা চিন্তাবিদও এখন যুদ্ধ শেষ করতে ইউক্রেনকে ছাড় দেওয়ার কথা বলছেন। ১৯৯০-এর দশকে সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত থেকে বের করতে পশ্চিমারা পাঁচ লাখ সেনার বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছিল; কিন্তু এখন পশ্চিমারা একনায়কদেরকে মোকাবেলা করতে যথেষ্ট ইচ্ছুক নয়। রুশ আগ্রাসন মোকাবেলায় ইউক্রেনকে যথেষ্ট সহায়তা না দেওয়ার অর্থ হলো, অন্যান্য একনায়কও মনে করতে পারে যে, তারাও পশ্চিমাদের তেমন কোনো বাধা ছাড়াই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে পারে। কন কাফলিনের কথায়, ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যুদ্ধ জেতানোর মাধ্যমেই বিশ্বের অন্যান্য একনায়ককে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। 

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি এনালিসিস’-এর ফেলো ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডওয়ার্ড লুকাস ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিন বছর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ যখন বলেছিলেন, ন্যাটোর ‘মস্তিষ্ক মৃত’, তখন তিনি সে সময়কার বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলেন। কারণ তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত হতে পারছিল না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার বুঝি ন্যাটো পুনরায় তার লক্ষ্য ফিরে পেয়েছে। তারা ইউক্রেনকে একযোগে অস্ত্র দিয়েছে, রাশিয়ার হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে, সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে, এবং পূর্বদিকের সীমানার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে; কিন্তু ন্যাটোর এই ‘হানিমুন’ এখন শেষ!

লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবার্গিস বলেছেন, ‘হানিমুন’-এর সময়টা ছিল স্বল্প সময়ের। যুদ্ধ যখন দীর্ঘ হতে শুরু করেছে, তখন এই ঐক্যে টানাপড়েন পড়েছে এবং এই জোট এখন দোদুল্যমান। রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে না দেখার কারণে ন্যাটোর পূর্ব দিকের সদস্য রাষ্ট্র পোল্যান্ড এবং তিনটা বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে দ্বিতীয় সারির সদস্য দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। পোল্যান্ডের প্রশ্নের উত্তরে ন্যাটো বলেছিল, ন্যাটোর পক্ষে এই দেশগুলোকে বেলারুশের আগ্রাসন থেকে সম্ভব হলেও, রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। 

কাউফম্যান বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলো সবার সামনে চলে এসেছে। একদিকে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে তৈরি করা বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখে বিপদে পড়েছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ মনে করছেন যে, ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপের যে নিরাপত্তা কাঠামো তিনি তৈরি করার স্বপ্ন দেখছিলেন, তা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভেস্তে যাচ্ছে। অপরদিকে পোল্যান্ড এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো মনে করছে যে, তারা এত দিন যাবৎ রাশিয়াকে যেভাবে অবিশ্বাস করত, তা এখন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। আর ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করাতেও তারা নিজেদেরকে আরও বলীয়ান ভাবছে। পোল্যান্ড তো ভাবতে শুরু করেছে যে, ইউক্রেনের সঙ্গে একযোগ হয়ে তারা ফ্রান্স ও জার্মানির পুরনো জোটের বিপরীতে একটা নতুন জোট গঠন করতে পারবে, যা যথেষ্ট শক্তিশালী হবে এবং প্রভাব বিস্তার করতে করবে। আর পশ্চিমাদের কাছ থেকে রাশিয়ার অপমানিত হওয়ার কিছু নেই; কারণ পুতিন নিজেই নিজেকে যথেষ্ট অপমান করেছেন। 

ইউক্রেনে হামলা শুরু করার আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে ব্যাপারগুলো ভেবেছিলেন তার মাঝে হয়তো বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তহীনতার ব্যাপারটাও ছিল। তবে এর অর্থ তা নয় যে, তিনি ইউক্রেনকে যেনতেনভাবে হারাতে পারতেন। কিয়েভ ও খারকিভ থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর বুঝতে বাকি নেই যে, পুতিনও যুদ্ধ শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছেন। তবে পশ্চিমাদের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যের ব্যাপারে অনৈক্য যখন আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন আবারও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের উপরেই সবাইকে নির্ভর করতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ করার কথা বলছে, তখন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের লক্ষ্যগুলো গৌণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে, যা গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়ে বিকল্পের রাস্তা প্রসারিত করছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫