Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

পেলোসির তাইওয়ান সফর : মার্কিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২২, ১৫:৩২

পেলোসির তাইওয়ান সফর : মার্কিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েনের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।ছবি : রয়টার্স

আগস্টের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রবীণ নেতা ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা চরমে উঠেছে। চীনা সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে ঘিরে বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করেছে।

ইতোমধ্যেই চীন কয়েক দশকে প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের উপর দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক যুদ্ধ সংগঠিত না হওয়ার ব্যাপারে মত দিলেও উত্তেজনা সংক্রমিত হওয়ার ব্যাপারটাকে সবাই ভীতির চোখে দেখছেন।  

জাপান সফরের সময় পেলোসি তার তাইওয়ান সফরের পক্ষে এই বলে যুক্তি দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে একঘরে করে ফেলার চীনা পরিকল্পনার বিরোধী। তার তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ দিতে চাইছেন যে, চীন মার্কিনিদেরকে তাইওয়ান সফরে বাধা দিতে পারবে না। তবে তিনি এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা পরিবর্তনের পক্ষে নন।

বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীন এখন যে ধরনের সামরিক উত্তেজনা তৈরি করেছে, সেটা যদি তারা পরবর্তী সময়েও করতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ অঞ্চলের স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে তাইওয়ানের আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বিমানের চলাচল বন্ধ করে অবরোধের মহড়া সত্যিকার অর্থেই একটা বড় পরিবর্তন। আর এই মহড়া চলছে বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য রুটের উপর; যেখান থেকে দুনিয়ার বেশিরভাগ সেমিকন্ডাকটরের সরবরাহ আসে। ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যে কেউই চাইবে যাতে এ ধরনের উত্তেজনা যেন বেশিদিন স্থায়ী না হয়। পেলোসির তাইওয়ান সফর ছিল ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মার্কিন রাজনৈতিক নেতার প্রথম সফর।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও থিঙ্কট্যাঙ্ক এশিয়া সোসাইটির প্রধান কেভিন রাড এবিসি নিউজকে বলেন, পেলোসির সফরের ফলে তাইওয়ানের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেল কিনা, সে ব্যাপারে তিনি একেবারেই নিশ্চিত নন। বিশেষ করে এই সফরের পর চীন সামরিক ও অর্থনৈতিক যেসব পদক্ষেপ নেবে, তা তাইওয়ানের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এছাড়াও পেলোসির সফরের কারণে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়েছে। তিনি হয়তো তাইওয়ানের সঙ্গে একাত্মতা ও মানবাধিকার বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরতে সেখানে যেতে পারেন যেগুলো তার ব্যক্তিগত আদর্শিক রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তার তাইওয়ান সফর ছিল অবিবেচকের কাজ। আজকের এই উত্তেজনা একসময় যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর ঠিক এ কারণেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি। 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রধান ইয়ান ব্রেমার জি-জিরো মিডিয়ার এক বিশ্লেষণে বলেন, এই মুহূর্তে কেউই হয়তো তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে কথা হোক সেটা চাননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও নিঃসন্দেহে চাননি। অন্তত এখন তো নয়ই; বিশেষ করে এই বছরেই যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে শি জিনপিং তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পেলোসি প্রথমে তার এশিয়া সফরসূচিতে তাইওয়ানের নামটা লিখিত আকারে দেওয়া থেকেও বিরত ছিলেন। সফরের দুই সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউস জানতে পারে, পেলোসি তাইওয়ান সফর করতে চাইছেন। এই খবরটা তখনো মিডিয়াতে আসেনি। তবে হোয়াইট হাউস থেকে পেলোসির কাছে চিঠি দিয়ে তাইওয়ান সফরের ব্যাপারে মানা করার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায়। বাইডেন হয়তো সমস্যায় পড়েছেন যে, পেলোসিকে যেতে দেওয়ার অর্থ হলো দলের উপর বাইডেনের প্রভাব নেই; অপরদিকে পেলোসিকে যেতে মানা করার অর্থ হলো বাইডেন তাইওয়ান নীতিতে দুর্বল।

এছাড়াও চীনের দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, পেলোসির সফরের ব্যাপারে চীনকে একটা শক্ত প্রত্যুত্তর দিতেই হবে; না হলে চীনা নেতৃত্ব তাদের জনগণের সামনে হেয় হবে। এ কারণেই চীন বারংবার এই সফরের বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে না যায়। উদাহরণস্বরূপ, দুই মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ না করে এবং রাশিয়ার উপর অবরোধ না ভাঙে। চীন এই হুমকিতে অত্যন্ত অখুশি হলেও তারা মোটামুটিভাবে মার্কিনিদের কথা শুনেছে। তবে তাইওয়ানের ইস্যু চীনের কাছে পুরোপুরিভাবে আলাদা। 

৮২ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ পেলোসির অভিজ্ঞতা একেবারেই কম নয়। জন্মের পর থেকেই তিনি রাজনীতি দেখছেন। তার বাবা টমাস দালেস্রান্দো জুনিয়র ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন কংগ্রেসম্যান। ১৯৭৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে পেলোসির নির্বাচিত হওয়া শুরু। ১৯৮৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে তিনি নির্বাচিত হয়ে কংগ্রেসে পদার্পণ করেন। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি কংগ্রেসের স্পিকার নির্বাচিত হন। মার্কিন রাজনীতিতে এক ব্যক্তি কি ইচ্ছা করলেই অন্য দেশের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারেন? এখানে প্রেসিডেন্টের কি কিছুই করার ছিল না; নাকি তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝে আরেকটা অস্থিরতাকে মেনে নিয়েছেন? কেভিন রাড বলেন, মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী কংগ্রেসের স্পিকার যে কোনো স্থানে যেতে পারেন। এখানে হোয়াইট হাউসের বাধা দেওয়ার তেমন কিছুই নেই। বরং এখানে প্রশ্ন হলো, স্পিকার নিজে কি তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেননি? উচ্চপদে আসীন হয়ে তার বোঝা উচিত ছিল যে, তাইওয়ান সফর করাটা দেশটির দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য ভালো হবে কিনা; অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো হবে কিনা। পেলোসি এই ব্যাপারগুলো চিন্তা করেননি। 

ব্রেমার বলেন, বাইডেনের পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে মানা করার এখতিয়ার না থাকলেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি পেলোসির তাইওয়ান সফরে বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন; যা তিনি করেননি। তিনি পেলোসির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চাননি; বরং চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। অপরদিকে চীন খুব সম্ভবত তাদের পার্টি কংগ্রেসে তাইওয়ানে কে যেতে পারবে এবং কী করতে পারবে, সে ব্যাপারে তাদের নীতির পরিবর্তন করবে; যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধিতে অনেক বেশি প্রভাব রাখবে। ফলস্বরূপ, সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রগুলোকে তা আরও অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে। অন্ততপক্ষে রাশিয়ার সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে কেউই এমনটা চাননি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫