‘লিলিবেট’ থেকে ‘এলিজাবেথ’, দায়িত্বে ছিলেন অটুট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৪২

পরিবারের সাথে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ছবি: বিবিসি
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। ১৯২৬ সালের ২১শে এপ্রিল লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে একসময় রানি হবেন একথা খুব কম লোকই তখন ধারণা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে তার চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড দুবার তালাকপ্রাপ্ত এক আমেরিকান নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেন।
তখন রাজকুমারী এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজা হন এবং ১০ বছর বয়সী ‘লিলিবেট’, যে নামে তাকে পরিবারের মধ্যে ডাকা হতো, তিনি হন ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী।
এর তিন বছরের মধ্যে ব্রিটেন নাৎসি জার্মানির সাথে যুদ্ধে জাড়িয়ে পড়ে। যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ এবং তার ছোট বোন প্রিন্সেস মার্গারেটকে কানাডায় সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হলেও তাদের বাবা-মা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দুই বোন ওই মহাযুদ্ধের বেশিরভাগ সময়টাতে বসবাস করেন ইংল্যান্ডের বার্কশায়ার কাউন্টির উইন্ডসর প্রাসাদে।
বয়স ১৮ পেরোনোর পর যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছে সেই সময়টাতে তিনি তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় গ্রিসের রাজপুত্র ফিলিপের সাথে চিঠি আদান-প্রদান শুরু করেন। ফিলিপ তখন ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
তাদের মধ্যে রোমান্স বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৭ সালের ২০শে নভেম্বর ওয়েস্টমনিস্টার অ্যাবি গির্জায় তারা বিয়ে করেন। এই বিয়ের সুবাদে প্রিন্স ফিলিপ ডিউক অফ এডিনবরা উপাধি লাভ করেন।
রাজকীয় দম্পতির প্রথম পুত্র চার্লসের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে, এরপর প্রিন্সেস অ্যান ১৯৫০ সালে, প্রিন্স অ্যান্ড্রু ১৯৬০ সালে এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে মোট আট জন নাতি-নাতনি এবং ১২ জন পুতি-পুতনি উপহার দিয়েছেন।
১৯৫২ সালে যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ যখন কেনিয়া সফর করছিলেন তখন প্রিন্স ফিলিপ তাকে তার বাবার মৃত্যুর খবর দেন। ব্রিটেনের নতুন রানী হিসাবে তিনি দ্রুত লন্ডনে ফিরে আসেন।
‘এটি ছিল হঠাৎ করেই দায়িত্বভার হাতে তুলে নিয়ে সাধ্যমতো সেরা কাজটি করার মতো ঘটনা,’ পরে তিনি বলেছিলেন।
সাতাশ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালের ২ জুন রাজকুমারী এলিজাবেথকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি গির্জায় ব্রিটেনের রানির মুকুট পরানো হয়েছিল।
এর পরের দশকগুলোতে দেখা গিয়েছিল বিশাল সব পরিবর্তন। বিদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান এবং ‘সুইংগিং সিক্সটি’ নামে পরিচিত ’৬০-এর দশক, যে সময়ে ব্রিটেনের পুরনো সব সামাজিক নিয়মকানুন ভেসে গিয়েছিল।
এমন এক সময় যখন রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধায় ক্ষয় ধরেছিল, সেই সময়টিতে রানি এলিজাবেথ মনোনিবেশ করেন রাজতন্ত্রের সংস্কারে, সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এবং নানা ধরনের রাজকীয় পরিদর্শনে। কমনওয়েলথের প্রতি তার ছিল অবিচল অনুরাগ। অন্তত একবারের জন্য হলেও তিনি প্রত্যেকটি কমনওয়েলথ রাষ্ট্র পরিদর্শন করেছিলেন।
কিন্তু প্রকাশ্য এবং ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য অনেক বেদনার দিনও ছিল। ১৯৯২ সাল, যাকে তিনি বলেছিলেন ‘অ্যানাস হরিবিলিস’ (ভয়ঙ্কর বছর), সে সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটে উইন্ডসর প্রাসাদে। এটি ছিল একইসাথে তার অফিস ও ব্যক্তিগত বাসস্থান। ওই সময়টাতে তার তিন সন্তানের বিয়ে ভেঙ্গে যায়।
উনিশশো সাতানব্বই সালে প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওয়েলসের রাজকুমারী প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর জনসাধারণের মধ্যে রানির কঠোর সমালোচনা হয়। অভিযোগ ছিল, ওই মৃত্যুতে তিনি যথোপযুক্ত শোক পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দীর্ঘ রাজত্বকাল জুড়ে ছিল তাঁর কঠোর কর্তব্যপরায়ণতা এবং ব্রিটিশ সিংহাসন ও ব্রিটিশ জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনকে নিবেদন করার ব্যাপারে তাঁর নিষ্ঠা ও অঙ্গীকার।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনও অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন একজন ধ্রুবতারা।
উত্তাল নানা সময়ের মধ্যেও ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে তিনি যেভাবে টিকিয়ে রেখেছেন তা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তা আরো স্মরণীয় এ কারণে যে তাঁর জন্মের সময়ও কেউ ভাবেননি তাঁর ভাগ্যে রয়েছে ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ।
২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আসীন থাকার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর বাবার প্র-পিতামহী রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের মেয়াদ ছিল এর চেয়ে কম।
তবে এই গৌরব নিয়ে রানি কখনও বাড়াবাড়ি করেননি। তাঁর নিজস্ব বিনয়ী স্টাইলে তিনি বলেছিলেন, এমন কোন ‘সম্মান’ অর্জনের লক্ষ্য আমার কখনই ছিল না।
এর এক বছর পর ২০১৬ সালে রানি তাঁর ৯০ বছরের জন্মদিন পালন করেন।
নব্বই বছর পার করেও তিনি তাঁর রাজ দায়িত্ব চালিয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী ডিউক অফ এডিনবারা, প্রিন্স ফিলিপ অবসর নেবার পরেই তিনি একাই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন।
রানির দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ প্রয়াত হন ২০২১-এর এপ্রিল মাসে।
তাঁর কর্মজীবনে বিচলিত হবার মত নানা মুহূর্ত এসেছে, কিন্তু রানি সবসময়ই তাঁর স্থৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, তিনি দৃঢ় হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
রানির রাজত্বকালের শুরুর সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র যে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের তখন প্রবল আনুগত্য ছিল, তাঁর রাজত্বকালের শেষ সময়ে সেই উচ্ছ্বাস ও আনুগত্যে কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল বটে, কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে রাজপরিবারের প্রতি ভালবাসা যাতে চিরস্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করতে সারা জীবন সচেষ্ট ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
তাঁর সিংহাসন আরোহণের রজত জয়ন্তীর সময় তিনি ৩০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় তার এক অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।
‘আমার বয়স যখন ২১, আমি অঙ্গীকার করেছিলাম আমার জীবন আমি উৎসর্গ করব আমার জনগণের সেবায়। আমি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষায় ঈশ্বরের সাহায্য কামনা করেছিলাম। আমার বয়স তখন ছিল অল্প, আমার বিচারবুদ্ধি পরিপক্ব ছিল না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি কখনো অনুতাপ করিনি। আমি সেই প্রতিশ্রুতি থেকে কখনো এক চুলও সরে আসিনি।’
সূত্র: বিবিসি