Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিশ্ব কূটনীতি

Icon

এম এ আল আমিন

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২, ১৪:০৮

ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিশ্ব কূটনীতি

প্রতীকী ছবি।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক অবনতি হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর সরকারের অন্যান্য বিভাগ ও এজেন্সিগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ (জিটুজি) বাতিল করার নির্দেশনা জারি করে। কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ুর মতো ইস্যুগুলো নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন মস্কোর সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করে।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের মধ্যে জুলাইতে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি। সেটি কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ইউরোপীয় নেতাও ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগযোগ বন্ধ রেখেছেন।

কেবল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ মস্কোর সঙ্গে কূটনীতির দুয়ার খোলা রাখেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে শান্তি প্রক্রিয়ায় রাজি করানোর প্রত্যাশায় তিনি মে মাসে মস্কো সফর করেন। বলা বাহুল্য, ম্যাক্রোঁর এই উদ্যোগ সফল হয়নি। তিনি বরং তার ইউরোপীয় প্রতিপক্ষদের কাছে উপহাসের পাত্র হন। পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আড়ালে চলে যায়। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাশিয়াকে একঘরে করে রাখার পশ্চিমাদের চেষ্টা আখেরে ভালো ফল বয়ে আনবে না। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কূটনীতির ধারায় পরিবর্তন আসুক, রাশিয়া এটা অনেকদিন ধরেই চেয়ে আসছিল। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি সে রকম একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।

পশ্চিমারা রাশিয়াকে যতই একঘরে করার চেষ্টা করুক, দীর্ঘমেয়াদে তাদের মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে। সেক্ষেত্রে মধ্যস্থতার জন্য তাদের তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হতেই হবে। যেমন- তুরস্কের মতো কোনো দেশ। এর মধ্য দিয়ে কূটনীতিতে নতুন ধারার সূচনা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে তখন দুই মেরুব্যবস্থা গড়ে উঠবে। রাশিয়া সম্ভবত সেটাই চাইছে। 

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে এক টেবিলে বসানোর একটি উদ্যোগ সুইডেন চলতি বছর এপ্রিলে নিয়েছিল। সুইডেনের জেনিভা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ শান্তি আলোচনার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিবাদ নিরসনের ক্ষেত্রে এই নগরী একটি নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে বিবেচিত; কিন্তু মস্কো সুইজারল্যান্ডের ‘অবন্ধুসুলভ আচরণের’ উল্লেখ করে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল।

প্রসঙ্গত, সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়ার বিষয়টি এখানে আসতে পারে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় সিরিয়ার একটি সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।সিরিয়ায় নিযুক্ত রাশিয়ার বিশেষ দূত আলেক্সান্ডার লাভরেনতিয়েভ জুনে বলেছেন, জেনেভা থেকে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের আলোচনা কোনো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে সরিয়ে নেওয়া উচিত। লাভরেনতিয়েভের দৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যের নগরী আলজিয়ার্স, আবুধাবি, মানামা অথবা মাস্কাট হতে পারে বিকল্প ভেন্যু।

একই সময় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কথাও জানিয়েছে- দক্ষিণ ককেশাস নিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি আলোচনা আর জেনেভায় হবে না। ক্রেমলিন একথাও বলেছে, জাতিসংঘ সদর দফতর নিউইয়র্ক থেকে সরিয়ে আনা উচিত। গত মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে রুশ প্রতিনিধি দলকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিতে অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ মস্কো এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। 

ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়া বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্কের মধ্যস্থতা মেনে নিয়েছে। মধ্যস্থতার বিষয়বস্তু ছিল ইউক্রেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম সফলতা আসে জুলাইতে। রাশিয়া রাজি হওয়ায় খাদ্যশস্যবাহী জাহাজগুলো তখন ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দর ছেড়ে যায়। এ ছাড়া ইউক্রেনের মারিয়াপোলের ভেতর দিয়ে একটি মানবিক করিডর খোলার অনুমতি দিতেও সম্মত হয়েছিল মস্কো। এর জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইস্তাম্বুলে দফায় দফায় বৈঠকে বসতে হয়েছে। 

তুরস্কে আগামী বছর নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান নির্বাচনের আগে নিজের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করতে সচেষ্ট। খাদ্যশস্য রপ্তানির সাফল্যের উদাহরণ দেখিয়ে তুরস্কের কর্মকর্তারা এখন যুদ্ধবন্দি বিনিময় ও ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারেও অগ্রগতি আশা করছেন। রাশিয়া এখনো যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো গ্রিন সিগন্যাল না দিলেও তুরস্কের ভূমিকা অগ্রাহ্য করতে পারছে না। কারণ সিরিয়া, লিবিয়া ও নগর্নো কারাবাখে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আঙ্কারার প্রয়োজন হবে।   

বস্তুত মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তেমন নেই। পুতিন ও এরদোয়ানের ব্যক্তিগত সম্পর্কই এখানে মূল নিয়ামক। তার পরও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সম্পর্ক একটি আশার আলো জিইয়ে রেখেছে। কারণ পশ্চিমা দেশগুলো বা জাতিসংঘ গত আট মাসে সফলতার কোনো নজির দেখাতে পারেনি। ন্যাটো সদস্য হওয়ায় তুরস্ক পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার পাশাপাশি বাকি বিশ্বের সঙ্গেও যোগাযোগ বজায় রেখেছে। পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে নিয়মিত টেলিফোনে আলাপ।

ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পরও মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে ন্যাটোর কিছু সদস্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ইতোমধ্যে রাশিয়ার ওপর কতগুলো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তুরস্ক যদি এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর তোয়াক্কা না করে তবে পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিই দেশটির সহমর্মিতা ও একাত্মতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তবে এরদোয়ানের উপদেষ্টা মেসুত কাসিন বলেছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে যোগাযোগ একটি স্বাভাবিক বিষয়। এটি ন্যাটোর প্রতি তুরস্কের দায়বদ্ধতা প্রশ্নের মুখে ফেলে না। 

রাশিয়া ও তুরস্কের কূটনীতিকরা পারষ্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে চলেছেন। পুতিন জুনে ব্রিকসের সম্মেলনে বলেছেন, এই জোট এক মেরু বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে নতুন আলো দেখাতে পারে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সমম্বয়ে গঠিত ২০০৯ সালে জোটটি গঠন হয়েছিল।

এবারের সম্মেলনে আর্জেন্টিনা, ইরান, মিসর, সৌদি আরব ও তুরস্কের কূটনীতিকরা যোগ দিয়েছিলেন। জানা গেছে, এদেশগুলো জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। বিকল্প কূটনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার রুশ উদ্যোগ আসলে নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৬ সালেই দেশটির নীতিনির্ধারক মহল এর রূপরেখা তৈরি করেন। ২০১৭ সালে রাশিয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়ায়। তুরস্ক ও ইরানকে নিয়ে গঠন করে অস্তানা গ্রুপ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫