Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

বিবিধ চ্যালেঞ্জে কংগ্রেসের অশীতিপর নতুন নেতা

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১৪:৪৯

বিবিধ চ্যালেঞ্জে কংগ্রেসের অশীতিপর নতুন নেতা

রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মাল্লিকার্জুন খাড়গে। ছবি: ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

ভারতের শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেস। যেমনটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল- কর্নাটকের প্রবীণ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেই হয়েছেন কংগ্রেসের নতুন সভাপতি। ফলে দুই দশক পর অগান্ধী সভাপতি পেল কংগ্রেস। অশীতিপর এ নেতার এক মুহূর্ত বসে থাকার কোনো অবকাশ নেই।

ক্ষমতাসীন বিজেপিকে মোকাবিলা বা জোটগঠনই শুধু নয়, দলের অভ্যন্তরে রয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এসব চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি কতটা সোচ্চার থাকতে পারেন, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। 

দেশব্যাপী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ চালাচ্ছে ভারতের সবচেয়ে পুরনো দল কংগ্রেস। এর মধ্যেই ১৭ অক্টোবর দলটির সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুদিন পর ১৯ অক্টোবর দিল্লিতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভোট গণনার পর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। সভাপতি নির্বাচনে ‘হাই কমান্ডের প্রার্থী’ হিসেবে পরিচিত খাড়গে পেয়েছেন ৭ হাজার ৮৯৭ ভোট। প্রতিপক্ষ শশী থারুর পেয়েছেন ১ হাজার ৭২টি ভোট। অর্থাৎ ৬ হাজার ৮২৫ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন খাড়গে।

শেষবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন হয়েছিল ২০০০ সালে। সেবার সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের নেতা জিতেন্দ্র প্রসাদ। সোনিয়ার বিরুদ্ধে জিতেন্দ্রর প্রাপ্ত ভোট তিন সংখ্যাতেও পৌঁছায়নি। এবারের নির্বাচনে দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চার দাবি করলেও গান্ধী পরিবারের প্রভাবের বাইরে যে দলটি আসেনি, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। তবে এর মধ্যদিয়ে প্রায় দুই দশক পর গান্ধী পরিবারের বাইরে সভাপতি পেয়েছে কংগ্রেস। দলটির প্রায় ১৩৭ বছরের ইতিহাসে এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সভাপতি বেছে নেওয়া হলো।

কংগ্রেসের নির্বাচন নিয়ে কিছুটা অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে। সকালে ভোট গণনা শুরুর কিছু পরেই থারুরের নির্বাচনী এজেন্ট সালমান সোজ বিপুল অনিয়মের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ প্রধানত উত্তরপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানাকে কেন্দ্র করে। থারুর এক চিঠিতে মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা মধুসূদন মিস্ত্রিকে বলেন, প্রতিটি অভিযোগই গুরুতর।

রাজ্য স্তরের নেতাদের কাছ থেকে বা শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে তিনি খাড়গের মতো সহযোগিতা পাননি। প্রচারে সাহায্য করা তো দূরের কথা, কোনো কোনো রাজ্যে থারুরকে প্রচারে বাধা দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। তবে ফল ঘোষণার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য থারুর খাড়গেকে শুভেচ্ছাই জানিয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর খাড়গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ও সংবিধান রক্ষার মাধ্যমে দেশকে বাঁচানো দলের প্রধান কাজ।’ 

কে এই মল্লিকার্জুন খাড়গে

জাতিগতভাবে দলিত সম্প্রদায়ের ৮০ বছর বয়সী মল্লিকার্জুন খাড়গের রয়েছে দীর্ঘ সময়ের জনসম্পৃক্ততা। প্রায় অর্ধশতক ধরে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তিনি। তার জন্ম ১৯৪২ সালে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের বিদর জেলার ভালকি তালুকের ভারাওয়াট্টিতে। বেড়ে ওঠেন পাশের গুলবারগা জেলায়। সেখানকার একটি বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। এর পর স্থানীয় সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি ও শেঠ শঙ্করলাল লাহোটি আইন কলেজ থেকে আইন ডিগ্রি অর্জন করেন। আইনি কর্মজীবনের প্রথম দিকে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষে মামলা লড়ে আলোচনায় আসেন তিনি।

এর পর ১৯৬৯ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং গুলবারগা নগর কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হন। ১৯৭২ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন খাড়গে। সেই সময় কংগ্রেসের কর্নাটক রাজ্যের প্রধান ছিলেন দেবরাজ উরস। খাড়গেকে গুরমিতকাল আসনে প্রার্থী করেন তিনি। প্রথমবারই জয় পান খাড়গে। এর পর একই আসন থেকে ধারাবাহিকভাবে আরও ৮ বার নির্বাচিত হন তিনি। এ ছাড়া চিতাপুর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জয়ী হন খড়গে। ২০১৪-২০১৯ সময়কালে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন তিনি। 

কংগ্রেস পুনর্গঠন

ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে পুরনো দল হিসেবে কংগ্রেসের নিজস্ব পরিচালনা পদ্ধতি ও গতানুগতিক ধারা থাকলেও দলটিকে এখন তার আগের ধাঁচে পরিবর্তন আনতে হবে। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং তাদের মনের জায়গা পুনর্দখল করতে হলে কংগ্রেসকে অবশ্যই নতুন পথ খুঁজতে হবে; দিতে হবে নতুন কিছু। প্রসঙ্গত কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ শশী থারুরকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। এখন তাদের মন নিতে হলে খাড়গেকে ওই প্রজন্মের মনোভাব বুঝতে হবে। 

দলের রাজনৈতিক বার্তাগুলো হতে হবে অভিনব এবং তা দ্রুতই পৌঁছে দিতে হবে জনতার কাছে। কংগ্রেসের অনেক নেতাই মনে করেন, হিন্দুত্ববাদ, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর মতো অনেক আদর্শিক বিষয়েই কংগ্রেসের স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। আর এসব ইস্যুতে দলের ভেতরও দেখা দিচ্ছে বিভক্তি।

কংগ্রেস বরাবরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসছে; কিন্তু সরকারের সেসব পদক্ষেপের বিপরীতে বিকল্প অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের ধারণ তুলে ধরছে না। এটি দলের বড় একটি সীমাবদ্ধতা। এর ফলে দলের অনেক বড় নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে দল বদলানোর অভিযোগও উঠেছে। তবে এ নিয়ে কংগ্রেস কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দল পুনর্গঠনে এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ।

খাড়গের সামনে আরেকটি বড় পরীক্ষা হবে সাংগঠনিক সংস্কার। এখানে মূল বিষয়টি হলো- তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির (সিডব্লিউসি) নির্বাচনের জন্য চাপ দেবেন কিনা। কংগ্রেসের সংবিধান অনুযায়ী সিডব্লিউসি গঠিত হবে পার্টির সভাপতি, সংসদে কংগ্রেস পার্টির নেতা এবং ২৩ জন অন্যান্য সদস্য নিয়ে, যাদের মধ্যে ১২ সদস্যকে এআইসিসি নির্বাচিত করবে।

সিডব্লিউসিতে নির্বাচনের মাধ্যমে এর সংসদীয় বোর্ড প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন এবং লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের জন্য একটি প্রকৃত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি গঠনই হলো জি-২৩ গ্রুপের প্রধান দাবি। এই নেতারা থারুরকে বাদ দিয়ে সমর্থন দিয়েছেন খাড়গেকে। খাড়গে জি ২৩- এর দাবি খারিজ করে দিয়েছিলেন আগেই। এখন দেখার পালা, এসবের পরও খাড়গে দলের মধ্যে কতটা ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখতে পারেন। 

ভোটের চ্যালেঞ্জ

খাড়গে এমন একটা সময় দলের দায়িত্বে এলেন, যখন হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। আগামী বছর তার নিজের রাজ্য কর্নাটকসহ আরও ৯ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। আবার ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। খাড়গের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে অন্তত বড় রাজ্যগুলোতে জয় লাভের জন্য দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপির রাজনীতির বিপরীতে খাড়গেকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে আরও গতিশীল নেতৃত্ব দরকার। সাংবাদিক পূর্ণিমা জোশির মতে, তিনি (খাড়গে) একজন শালীন মানুষ ও তৃণমূলের রাজনীতিবিদ। তবে মোদি- শাহ জুটিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সক্ষম তিনি নন। কংগ্রেসের দরকার, যিনি বিজেপির খেলায় বিজেপিকেই হারিয়ে দেবেন এমন কাউকে। তবে কংগ্রেসের নতুন প্রেসিডেন্ট বিজেপির সঙ্গে আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন। যখন মানুষ দুই পক্ষের সঙ্গে তুলনা করবে, অন্তত খাড়গেকে ইতিবাচক হিসেবে নেবেন। 

জোটগঠন

বৃহৎ জোটগঠনের ক্ষেত্রে গান্ধী পরিবারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে। অন্য অনেক কংগ্রেস নেতার মতো খাড়গেও মনে করেন, কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়া কোনো বিরোধী দল থাকতে পারে না। তবে সময় ও পরিস্থিতি বদলেছে। অনেক আঞ্চলিক দলই এখন ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ভালো অবস্থানে থাকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগোচ্ছে। খাড়গের সামনে চ্যালেঞ্জটি হবে প্রতীকীভাবে হলেও দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য মিটমাট করে ঐক্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। 

এ ক্ষেত্রে তাকে একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আঞ্চলিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং তাদের নেতৃত্বের ভূমিকা দিয়ে কংগ্রেসের কি ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) পুনর্গঠনের চেষ্টা করা উচিত? খাড়গে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। শরৎ পাওয়ার, মমতা ব্যানার্জি, এমকে স্টালিন ও নীতিশ কুমারের মতো আঞ্চলিক নেতাদের মোকাবিলায় তিনি নিঃসন্দেহেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। তবে গান্ধী পরিবারের প্রক্সি দিতে গেলে তার নেতৃত্ব যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তেমনি বৃহৎ বিরোধী জোটগঠনের আকাক্সক্ষাও অপূর্ণই থেকে যাবে। এ ছাড়া কংগ্রেসের পক্ষে জাতীয় পরিসরে ভোটে অন্তত ভালো ফল করার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫