দীর্ঘ সংগ্রামের পর আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:২০

শূন্য থেকে নতুন রাজনীতি শুরু করেছিলেন আনোয়ার, এখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত
আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর ফলে গত ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশটিতে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল তার আপাত অবসান ঘটেছে।
আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নতুন পথচলা শুরু হলো। তবে এ পথ যে সহজ-সরল হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে কোনো দল বা জোটই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন নিশ্চিত করতে পারেনি।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনের ফল শেষ পর্যন্ত ঝুলন্ত পার্লামেন্টে গিয়ে ঠেকেছে। মালয়েশিয়ার নির্বাচন কমিশন বলেছে, ২২২ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট ৮২টি আসনে জয় নিশ্চিত করেছে।
আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের মালেভিত্তিক দল পেরিকাতান ন্যাসিনাল (পিএন) ৭৩টি আসনে জয় পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। সারাওয়াক রাজ্যের বোর্নিওতে বন্যার কারণে একটি আসনে ভোট স্থগিত করা হয়েছে। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের দল ইউনাইটেড মালয়জ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাসিওনাল (বিএন) নির্বাচনে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।
জোটটি মাত্র ৩০টি আসনে জয় পেয়েছে। তারা কোনো জোটকে সমর্থন না দেওয়ায় বিপত্তি বেধেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে ২২২টি আসনের মধ্যে ১১২টিতে জয় নিশ্চিত করতে হবে। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দল বা জোটই অর্জন করতে পারেনি।
সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাঁচ দিন ধরে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়। এতে সরকার গঠনের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের সমীকরণ নিয়ে আলোচনা হয়।
তবে সেগুলো সবই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও আদর্শগত বিরোধের কারণে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সাংবিধানিক প্রধান রাজা সুলতান আব্দুল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। রাজা রাজনৈতিক নেতাদের প্রাসাদে ডেকে এনে তাদের সঙ্গে এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য আলোচনা করেন।
তবে এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে নতুন সরকারের গঠন কেমন হবে, বিভিন্ন দলকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো জোট সরকার গঠিত হবে, অন্যান্য দলের সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার হবে, নাকি প্রধান প্রধান দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হবে।
মালয়েশিয়া কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে। কয়েক বছরের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে মালয়েশিয়া। সম্প্রতি দেশটিতে ‘স্থিতিশীলতা’ ফেরানোর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব আগাম নির্বাচনের ডাক দেন।
নির্বাচন পরবর্তী গোলযোগের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।
এ পরিস্থিতিতে আনোয়ার ইব্রাহিম প্রগতিশীল ও মুহিউদ্দিন রক্ষণশীল জোটের নেতৃত্ব দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন।
আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনের আগে একটি সাক্ষাৎকারে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বেন এবং দেশকে বর্ণবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করবেন। মুহিউদ্দিনের জোটে এবার বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে ইসলামিক পার্টির। ইসলামপন্থিদের উত্থান নিয়ে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মালয়েশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জাতি ও ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের দুই দশকের বেশি সময়ের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। ৭৫ বছর বয়সী এই নেতা বছরের পর বছর খুব কাছাকাছি এসেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তিনি ১৯৯০ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাহাথিরের সঙ্গে নির্বাচনী জোটের চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তবে সে অপেক্ষা তখন শেষ হয়নি।
এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। আমি মালয়েশিয়ার প্রতি আমার সত্যিকারের আনুগত্য প্রকাশ করব।’ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করা। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করাও তার সামনে চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া গোষ্ঠীগত উদ্বেগ কমাতেও কাজ করতে হবে তাকে। তবে তার সামনে এখন বড় বিষয় হচ্ছে আগামী বছরের বাজেট। নির্বাচনের আগেই এ বাজেট উত্থাপন করা হলেও তা পাস হয়নি।
এছাড়া পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে হবে তাকে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ইতোমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমকে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে বারিসান দলের পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়েছে, তারা মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করবে না। তবে আনোয়ারের সরকারকে সমর্থনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি দলটি।
মাহাথির মোহাম্মদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। পরিচিত ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক, উচ্চাকাক্সক্ষী ও সংস্কারপন্থি রাজনীতিক হিসেবে। মনে করা হয়, মালয়েশিয়ার আজকের উন্নয়নের পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তাকে ভাবা হতো মাহাথিরের উত্তরসূরি।
কিন্তু ১৯৯৮ সালে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে মামলা হয়। তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক জীবন হয়তো শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি আবার ফিরে এলেন।
তার সাজা ২০০৪ সালে বাতিল করে দেওয়া হলে তিনি পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি সংস্কারবাদী পাকাতান হারাপান পার্টির নেতৃত্ব দেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল ইউএমএনও পার্টিকে প্রায় পরাজিত হওয়ার মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
কিন্তু তখন তার বিরুদ্ধে আবারও সমকামিতার অভিযোগ আনা হয় এবং ২০১৫ সালে তাকে পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে বিরোধিতা তীব্র হলে মাহাথির মোহাম্মদ তার অবসর জীবন থেকে রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে সমঝোতা করেন। তারা দুজনে একত্রিত হয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে নির্বাচনে পরাজিত করেন।
জোটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তাদের সরকারের আমলে মাহাথির ও তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাহাথির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আবার তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়।
এত কিছুর পরও তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তবে এই পদ তিনি কতদিন ধরে রাখতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।