শি জিনপিংয়ের মধ্যপ্রাচ্য সফরে ‘নতুন যুগ’ শুরু

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:১১

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সৌদি আরব সফর। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সৌদি আরব সফরের সময় গত ৯ ডিসেম্বর দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) বলেন, চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের ‘নতুন যুগ’ শুরু হয়েছে।
এর আগের দিন দুই দেশের মাঝে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি বাদশাহ সালমান দুই দেশের মাঝে প্রতি দুই বছর অন্তর শীর্ষ বৈঠক করার ব্যাপারে সম্মত হন।
এদিকে বার্তা সংস্থা ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই ঘোষণাটা এমন সময়ে এলো, যখন হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সৌদির সম্পর্কের ভাটা চলছে। পাঁচ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় এ রকম স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ওয়াশিংটনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেন, তারা মনে করছেন না যে, রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে কোনো একটা পক্ষকেই সমর্থন করে যেতে হবে; অথবা একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার অর্থ এই নয় যে, বাকিদেরকে দূরে ঠেলে দিতে হবে।
শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাঝে জ্বালানি ছাড়াও রয়েছে ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’, তথ্য প্রযুক্তি, পরিবহন ও কনস্ট্রাকশন। চীনা কোম্পানি ‘হুয়াই’ সৌদি আরবে ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’, ডাটা সেন্টার ও ‘হাইটেক কমপ্লেক্স’ তৈরি করা ক্ষেত্রে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে চীনের সঙ্গে সৌদি সহযোগিতা করবে এবং একই সঙ্গে তেলের বাইরে অন্যান্য সেক্টরে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে।
তবে চীনের অর্থনীতি যখন মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল, তখন সহযোগিতার কেন্দ্রে যে জ্বালানি থাকবে, তা বোঝাই যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক রবার্ট মগিয়েলনিকি বলেন, অনেকগুলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও জ্বালানিই সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি হবে। তবে দুই দেশের প্রযুক্তিগত চুক্তিগুলো ওয়াশিংটনকে যথারীতি বিচলিত করবে। নিরাপত্তার কথা বলে মার্কিনিরা আরও আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে চীনা কোম্পানির ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক স্থাপনে বাধা দিচ্ছে; যা আরব দেশগুলো আমলে নেয়নি।
তেল ও গ্যাসের মূল্যশোধ মার্কিন ডলারের বদলে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে করার সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে চীন ‘সাংহাই পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস এক্সচেঞ্জ’কে পুরোপুরি ব্যবহার করতে চাইছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৌদি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, চীনের কাছ থেকে সৌদি যা আমদানি করছে, তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়তো স্বল্প পরিমাণে তেলের বাণিজ্য ইউয়ানে করা যেতে পারে। কিন্তু মূল বাণিজ্য ইউয়ানে করার জন্যে এটা এখনই হয়তো সঠিক সময় নয়।
কারণ সৌদির বেশিরভাগ সম্পদ ও রিজার্ভ রয়েছে মার্কিন ডলারে। সৌদি প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আর সৌদির নিজস্ব মুদ্রা রিয়ালের মূল্যমানও নির্ধারিত হয় ডলারের মূল্যমানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ‘সৌদি প্রেস এজেন্সি’ বলছে, সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের ২০২১ সালের বাণিজ্যের মূল্যমান ছিল প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে।
শি জিনপিংয়ের সফর শুধু সৌদি আরবের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ না। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো ছাড়াও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নেতাই জড়ো হয়েছিলেন জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে। যাদের মধ্যে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি, তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, সুদানের শাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, মরক্কোর প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখান্নুশ এবং লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নজিব মিকাতি।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জিনপিংয়ের এই সফর ছিল সমাজতান্ত্রিক চীনের জন্যে সবচাইতে বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। তবে চীন এমন এক অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে, যেখানকার নেতারা বহু বছর ধরে মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তার উপরে নির্ভরশীল।
তবে মানবাধিকার, জ্বালানি নীতি ও মার্কিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তার মতো ইস্যুতে সৌদির সঙ্গে হোয়াইট হাউসের দূরত্ব তৈরি হওয়ার সময়েই চীন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে মনোযোগী হয়েছে।
সৌদির সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো- উভয় দেশই একে অপরের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছে। অপরদিকে সৌদির অনেকেই তাদের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবি এক টুইটার বার্তায় বলেন, মার্কিন রাজনীতিবিদেরা সৌদি আরবকে সংজ্ঞায়িত করছে মানবাধিকার দিয়ে; অথচ মার্কিনিরা নিজেরাই তাদের বিশাল সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যর্থ হয়েছে। চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ত্র সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে সৌদি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওঠা-নামা দিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে।
চীনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি মূলত আগ্রাসী নয়। জ্বালানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উপরে নির্ভরশীলতা জিনপিংকে সৌদি আরবে ডেকে এনেছে। ডলারকে ইউয়ান দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টাও আপাতত দ্বিতীয় সারিতেই থাকছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের কোনো বক্তব্য নেই। আর নিরাপত্তার দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনের উপরে নির্ভরশীল নয়।
ইরাক ও আফগানিস্তানের ব্যর্থতা যেমন বন্ধুদের কাছে ওয়াশিংটনের মূল্যকে কমিয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের নিজস্ব রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন রাজনীতিবিদদের অর্থহীন আদর্শিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বকে ‘নিরপেক্ষ’ নীতিতে এগোতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। পশ্চিমাদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের বন্ধন এখন নিতান্তই স্বার্থের। পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বাস্তবতাই এখন মধ্যপ্রাচ্য ও চীন- উভয়ের সামনেই বাতিঘর স্বরূপ।