গাজায় ইরান ও যুক্তরাজ্য নির্বাচনের প্রভাব
চোখের জল কিংবা পানি সে তো নোনতাই থেকে যায়

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ২০:১৭

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডা. মাসুদ পেজেশকিয়ান ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ছবি: সংগৃহীত
ঘরের কাছে এবং বাড়ি থেকে বহুদূরে দুটি দেশে নেতৃত্ব বদলের নির্বাচন হলো। একটি দেশ গাজার মিত্রপক্ষ ইরান। অন্যটি শত্রুশিবিরের মিত্রপক্ষ যুক্তরাজ্য। ইরানে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থি নেতা। দীর্ঘ দেড় দশক পর যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় এলো লেবার পার্টি, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার। দুটি দেশে ক্ষমতার এই পালাবদল গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে কি কোনো প্রভাব ফেলবে?
ইসরায়েলি দখলদারত্ব আর অব্যাহত আক্রমণের শিকার ফিলিস্তিনিরা। সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকার শাসনভার গ্রহণ করে হামাস। সশস্ত্র সংগঠনের যোদ্ধারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ১১শর বেশি মানুষ নিহত হন। পাশাপাশি আড়াইশর মতো মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। ওই দিন থেকেই গাজায় পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নয় মাসের যুদ্ধে ৩৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, প্রতি ১০ ফিলিস্তিনির নয়জনই অন্তত একবারের জন্য হলেও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছেন।
এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রয়েছে ইরান, যারা হামাসকে স্বাধীনতাকামী সংগঠন মনে করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতোই পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপের দেশগুলো হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। যুক্তরাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। কনজারভেটিভ দলের সাবেক নেতা, সদ্য বিদায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সরকারও গাজায় গণহত্যা প্রতিরোধে ইসরায়েলকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি। এমনকি বিরোধী দলে থাকার সময়ও স্টারমারের লেবার পার্টি গাজায় ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছিল।
হামাসকে সহযোগিতার অভিযোগে ইরানের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরেই হামলা করে আসছিল ইসরায়েল। চলমান যুদ্ধে সেই হামলার হার ও তীব্রতা আরও বেড়েছে। মূলত ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে ইসরায়েল। এ বছর সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে হামলার পর দুই দেশের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ বড় হয়। ইসরায়েলের ভূমিতে প্রথমবারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করে তেহরান। এর কিছুদিনের মধ্যেই হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তার মৃত্যুর পর নির্বাচনে জয় পেয়েছেন সংস্কারপন্থি নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর করতে পারবেন না, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সম্পর্কের তিক্ততা তিনি ঠিকই কমিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু ইরানের যে কোনো নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের সর্বাধিকার যার হাতে ন্যস্ত, তিনি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ফলে মাসুদের উদারতা ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এদিক থেকে বলা যায়, গাজায় গণহত্যা চালানো ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আগের মতোই অবিশ্বাস ও শত্রুতাপূর্ণ থাকবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে সুনাকের দলকে হারিয়ে ১৪ বছর পর ক্ষমতায় এসেছে স্যার স্টারমারের লেবার পার্টি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করেছেন। ফোনালাপে স্টারমার অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য আর্থিক উপায় নিশ্চিত করাসহ দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি শর্তগুলো নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।’ এ ছাড়া একই দিন তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করে বলেছেন, ‘শান্তি প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার স্বীকৃতির বিষয়ে তার দীর্ঘদিনের নীতি পরিবর্তন হয়নি এবং এটি ফিলিস্তিনিদের অনস্বীকার্য অধিকার।’
কিন্তু স্টারমারের এই ফোনালাপ থেকে তার গাজানীতির পুরো চিত্র পাওয়া যায় না। বরং এর উল্টো রূপই প্রকৃত চিত্র। এবারের ভোটে লেবার পার্টি অনেক বেশি আসন পেলেও জাতীয় পর্যায়ে তাদের ভোটপ্রাপ্তি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তারা এবার পেয়েছে ৩৪ শতাংশ ভোট, যা ২০১৭ সালে করবিনের নেতৃত্বে দলটির পাওয়া ভোটের চেয়ে অনেক কম এবং ২০১৯ সালে পরাজিত হওয়ার বছরে পাওয়া ভোটের চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের ভোটে আরও বেশি শক্তিশালী জয় পেতেন স্টারমার; শুধু তার গাজা-বিরোধিতার জন্য অনেক লেবার সমর্থক ও নেতাকে তিনি হারিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ জেরেমি করবিন, লেবার পার্টির পরীক্ষিত সাবেক নেতা। স্টারমার গাজার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় করবিন এবার ভোটে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়েছেন, জয়ও পেয়েছেন। তার মতো অন্তত পাঁচজন ফিলিস্তিনপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী এবার ভোটে লেবার প্রার্থীকে হারিয়েছেন। এ ছাড়া সুনাক সরকারের সময় স্টারমারের গাজা-বিরোধিতার জন্য কয়েকজন লেবার আইনপ্রণেতা পদত্যাগ করেছিলেন।
ফলে গাজায় যেমন একরকম বিনা প্রতিরোধে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী, সামনের দিনগুলোতেও হয়তো তেমনই বর্বরতা দেখা যাবে। যুদ্ধবিরতির বৈশ্বিক আহ্বানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গড়ে প্রতি সপ্তাহে এক হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে নেতানিয়াহুর যুদ্ধবাহিনী, হয়তো সেই হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকবে। মানে, ইরানে মাসুদ পেজেশকিয়ান কিংবা ব্রিটেনে কিয়ার স্টারমার-নেতৃত্বের পালাবদল হলেও গাজাবাসীর ভাগ্যে শান্তি এখনো অনেক দূরের গল্প।