ইসরায়েলি ও মিত্রপক্ষের গণমাধ্যমগুলোতে এই খবর প্রচার করা হচ্ছে, ইরানের আরেকটি আক্রমণ থেকে নিজেদের আত্মরক্ষার কৌশল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছে ইসরায়েল। তেহরান থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের কড়া হুমকি তেল আবিবকে বিচলিত না করলেও সতর্ক রেখেছে। ইসরায়েল ২৬ অক্টোবর ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পশ্চিমা শক্তিগুলোর কৃত্রিম উপগ্রহে ধারণ করা ছবিতে পারচিন সামরিক ঘাঁটিতে অন্তত তিনটি ভবন আংশিক ধ্বংস হওয়ার চিত্র দেখা যায়। তবে ইরান ওই হামলার পরপরই বলেছিল, শত্রুশিবির পুরোদমে পরাস্ত হয়েছে, কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
ইসরায়েল দাবি করেছিল, অক্টোবরের শুরুর দিকে ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল তাদের মাটিতে, এরই জবাব হিসেবে মাসের শেষের দিকে পারচিনে তারা পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি চালায়। এই হামলার সাফল্য নিয়ে তারা বেশ ঢালাও প্রচার চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যেমনটা ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান ইরানের ভেতরে ঢুকতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইরাকের জমিন ব্যবহার করে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ওই সময় বলেছিলেন, ইসরায়েলি এই হামলা নিয়ে ‘বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলার কিছু নেই।’ তখনই পাল্টা জবাবের আভাস তিনি দিয়েছিলেন। ২ নভেম্বর তিনি স্পষ্ট সুরে বলেছেন, ‘ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী হোক কিংবা তাদের দোসর যুক্তরাষ্ট্র হোক, শত্রুদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অনিবার্য।’ এর দুই দিন আগে সর্বোচ্চ নেতার চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ মোহাম্মদি গল্পায়েগনি বলেছিলেন, ইরানের পক্ষ থেকে জবাব অবশ্যই দেওয়া হবে এবং সেই জবাব হবে ‘ভয়াবহ ও দাঁতভাঙা’।
একই দিন ইসলামিক বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেন, ইরান যে জবাব দেবে তা ‘কেউ কখনো কল্পনায়ও আনেনি’। তার ভাষায়, ‘কয়েকটা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ক্ষমতার আঞ্চলিক ভারসাম্য বদলে দেবে, এটাই ভেবেছিল ইসরায়েল। তারা আবার প্রমাণ করল যে ইরানের জনগণকে তারা ঠিকমতো পড়তে পারেনি। মনে রাখবেন, আপনাদের অঙ্কের পুরোটাই ভুল।’
৩ নভেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ইরানি ও আরব কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ইরানের এই জবাবমূলক হামলা ১ অক্টোবরের হামলার চেয়ে আরো জটিল হবে, আরো বেশি অস্ত্র ও অধিক শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহৃত হবে। হামলা কখন হতে পারে, এমন প্রসঙ্গে যা জানা যায়, এতে এমনকি সাম্প্রতিক দেশকালের পাঠক হিসেবে এই লেখা পড়ার আগেও হামলা হয়ে থাকতে পারে। আবার এও হতে পারে, ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা কমলা হ্যারিস শপথ নেওয়ার আগে যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে ইরান।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে বেশ কিছু পশ্চিমা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইরান সম্ভাব্য হামলাটি নিজেদের জমিন থেকে না চালিয়ে বরং ইরাক থেকে চালাতে পারে। ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের সঙ্গে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই মিলিশিয়াদের কাছে ইরান ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র জোগান দেয় বলে পশ্চিমাদের অভিযোগ। ১ অক্টোবরের হামলাটি ইরান থেকেই চালানো হয়েছিল। ইরাক থেকে হামলা চালালে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে তুলনামূলক কম সময় লাগবে ক্ষেপণাস্ত্রের। ইরান আগের হামলাটি করেছিল ২৭ সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার প্রতিবাদে। ইরানের বিরুদ্ধে শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার অভিযোগও আছে পশ্চিমাদের।
ইসরায়েলের কমান্ডাররা বারবার বলে আসছেন, নতুন করে ইরান হামলা চালালে তৎক্ষণাৎ পাল্টা হামলা চালাবে তারা। এতে ইরান বেকায়দায় বেশি পড়বে, কারণ তেল আবিবের দাবি, ২৬ অক্টোবরের হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাটারিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এক শিক্ষা-সমাপনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ইরানের শাসকদের কড়া কথায় ভয় পাই না আমরা। তারা আর এই সত্য লুকাবে কোথায়- এই সময়ই আমরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীন; প্রয়োজন পড়লে ইরানের ভেতরে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় আমরা ঢুকে যেতে পারি।’
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের শত্রুতা দীর্ঘদিনের। গাজায় গত বছর যুদ্ধ শুরুর পর এই সম্পর্ক আরো তিক্ত হতে থাকে। অতি সম্প্রতি গাজাকে কেন্দ্র করে লেবাননের হিজবুল্লাহর আস্তানা ও নেতৃত্বের ওপর ইসরায়েলি হামলা এবং পরে লেবাননে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যার অভিযোগে ইসরায়েলকে তোপ ও ক্ষেপণাস্ত্র দাগে ইরান। এ ধরনের কথার আক্রমণ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র দাগা অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সামরিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে, এতে সন্দেহ নেই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh