ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতেই ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয় রাশিয়া। ২০২২ সালের শুরুতে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের সরবরাহ ক্ষমতা দ্বিগুণ করতে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনটি চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পাইপলাইনটির অনুমোদন বাতিল করে জার্মানি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং ইউরোপের বেশ কিছু অংশ থেকে তীব্র বিরোধিতার জেরে শেষ পর্যন্ত জার্মানি প্রকল্পটি ছাড়তে বাধ্য হয়। রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ ব্যাপক ধাক্কা খায়। সংকট সামাল দিতে বিকল্প উৎস থেকে গ্যাস আমদানি করে মজুদ পূর্ণ করতে থাকে ইউরোপের দেশগুলো। এমনকি অঞ্চলটির রাজনীতিবিদরাও ঘোষণা দেন, গ্যাস সংকটের অবসান ঘটেছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপে গ্যাস সংকট এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
একসময় ইউরোপের বাজারে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহকারীদের একটি ছিল নেদারল্যান্ডস। তবে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশটিতে গত বছর উৎপাদন কমিয়ে আনা হয়। এখন উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা নেই, গ্যাস মজুদের পরিমাণও যথেষ্ট; তবে দাম বাড়ছে। তা ছাড়া শীতকাল সামনে রেখে চাহিদা কিছুদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। সব মিলিয়ে সামনের দিনে গ্যাসের দাম বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নরওয়ের রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানি ইকুইনর গত সপ্তাহে একটি উৎপাদন কেন্দ্রে ধোঁয়া দেখা যাওয়ায় উৎপাদন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল। এ খবর প্রকাশের পর ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার আদর্শ ডাচ টাইটেল ট্রান্সফার ফ্যাসিলিটির (টিটিএফ) দাম এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছায়। ১ নভেম্বর ডাচ টিটিএফের দাম প্রতি মেগাওয়াট-আওয়ার ৪৩ দশমিক ৬৮ ইউরোয় পৌঁছায়, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। বর্তমানে নরওয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী। এটি ইইউয়ের গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে। উৎপাদন স্থগিতের খবর দেওয়ার সময় ইকুইনর জানায়, এটি রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে না। তা সত্ত্বেও ইউরোপে গ্যাসের দাম বেড়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কসহ ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার পাইপলাইন গ্যাস সরবরাহ ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসে ২০২৩ সালে ৪৫ বিলিয়ন ঘনমিটারে দাঁড়ায়। তবে এ বছর আবার রপ্তানি বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-অক্টোবরে ইউক্রেনীয় অঞ্চল দিয়ে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে সরবরাহ করা গ্যাস আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। একই সময়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে তুর্কস্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ প্রায় ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ঘনমিটারে পৌঁছেছে।
রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে ইউরোপে রাশিয়ার পাইপলাইন গ্যাস রপ্তানি ১৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের একই সময়ে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ বিলিয়ন ঘনমিটার। বর্তমানে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ঘনমিটারে। ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে অঞ্চলটির গ্যাস আমদানিকারকরা বছরের শুরু থেকে মজুদ বাড়ানো শুরু করে। শীতকাল শুরু হওয়ার আগেই পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিতে তারা সফলও হয়েছে। বর্তমানে ইইউয়ের গ্যাস মজুদাগারগুলো ৯৫ শতাংশ পূর্ণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার শীতকালে গত দুই বছরের তুলনায় বেশি ঠান্ডা পড়লে এই মজুদ পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। তখন অঞ্চলটিতে গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে।
প্রাথমিক পূর্বাভাসেও এমনটা ঘটার আশঙ্কা দেখা গেছে। এতে বলা হয়, ইইউ ২০২২-২৩ সালের শীতকাল কোনো সংকট ছাড়া শেষ করতে পেরেছিল, কারণ সে বছর শীতকালে তুলনামূলক কম ঠান্ডা পড়েছিল। তবে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা একটি সতর্কবার্তা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এলএনজি রপ্তানি টার্মিনাল স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। কিন্তু নতুন টার্মিনাল নির্মাণে সময় প্রয়োজন। তা ছাড়া ইউক্রেন হয়ে রাশিয়া থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ ইউরোপে এখন গ্যাসের প্রয়োজন। বিকল্প হিসেবে আজারবাইজান থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হতে পারে। তবে আজারবাইজানের রপ্তানি সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এইচএসবিসির ইউরোপীয় জ্বালানি তেল ও গ্যাস গবেষণার প্রধান কিম ফুস্টিয়ার বলেন, ‘এই পরিস্থিতি নির্দেশ করে যে আগামী বছর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ ২০২৪-এর তুলনায় ভালো হবে না। বরং আরো খারাপ হতে পারে।’
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh