অর্থনীতির ছক বদলে দিচ্ছে ব্রিকস

প্রায় আড়াই বছর আগে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এর জের ধরে পশ্চিমা বিশ্ব নানা অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার ওপর। কার্যত দেশটিকে বৈশ্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছে পশ্চিমারা। তবে তা সফল হয়নি। বরং রাশিয়ার অর্থনীতি আরো বিস্তৃত হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন ছক গড়ে উঠছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সে কথারই জানান দেয় ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার পশ্চিমের কাজান নগরীতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এবারই প্রথম রাশিয়ায় এত বৃহৎ কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এ সম্মেলন আয়োজন করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেখাতে চেয়েছেন, রাশিয়ার অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার পশ্চিমা প্রচেষ্টা কতটা ব্যর্থ হয়েছে।

এবার এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পূর্ণ সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে ইথিওপিয়া, মিশর, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএএ)। যোগ দিতে আগ্রহী সৌদি আরবও। ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোসহ ৩০টিরও বেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পুতিন বুঝিয়ে দিলেন পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ‘একঘরে’ হয়ে যায়নি ক্রেমলিন। সম্মেলনে গোষ্ঠী-সদস্যরা গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও লেবাননে আক্রমণের জন্য ইসরায়েলের তীব্র নিন্দাও করেছেন। পশ্চিমের আইনবিরুদ্ধ একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও তারা ঐক্যবদ্ধ। যে পশ্চিমা পদক্ষেপ শুধু বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি করছে না, বহু দেশের সুস্থায়ী উন্নয়নের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সদস্য দেশগুলোর দাবি, সার্বভৌমত্ব, সাম্য, ঐকমত্য- এক ন্যায্য আর্থিক ও বাণিজ্যিক ধারার মতো জোটের বহুবিধ নীতির ফলে এই মঞ্চে যোগ দিতে আগ্রহী আরো বহু দেশ।

২০০৬ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন- এই চারটি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত ব্রিক ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার যোগদানের মধ্য দিয়ে ব্রিকসে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে অনেক ইচ্ছুক রাষ্ট্রের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর এ বছর জানুয়ারি মাসে মিশর, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইথিওপিয়া- এই পাঁচটি নতুন রাষ্ট্রের যোগদানের মধ্য দিয়ে এর পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ১০।

এবারের সম্মেলনে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল সুইফটের (দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশনস) বিকল্প কোনো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ২০২২ সালে সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে যুদ্ধ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তা নিয়েও ব্রিকস নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় স্থান দিয়েছেন।

এবারের সম্মেলনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই জোটটি পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় নানাভাবে চেষ্টা করে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার সুসম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। এবারের সম্মেলনটি যে কারণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে তা হচ্ছে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে ব্রিকসের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিসর অনেক বিস্তৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং জি৭-ভুক্ত দেশগুলোর আধিপত্যকে খর্ব করতে নানা রকম উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। ব্রিকসের ভৌগোলিক বিস্তৃতির কথা বলা হচ্ছে। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক দিন আগে জানিয়েছেন, ব্রিকসের সদস্য হতে ইচ্ছুক- এমন রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ৪০-এ দাঁড়িয়েছে।

অংশীজন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে ব্রিকস। আগামী দিনে ব্রিকসের ছায়ায় বহুপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্ককে নির্দিষ্ট করতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্মতি দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের আধিপত্য ও গুরুত্ব হ্রাস এবং আঞ্চলিক মুদ্রার সাহায্যে বিকল্প প্রক্রিয়া গড়ে তোলাও ব্রিকসের, বিশেষত রাশিয়া ও চীনের অন্যতম লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ব্রিকসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এটি। বর্তমানে যেকোনো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও ঋণের ক্ষেত্রে মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার মূল মুদ্রাও মার্কিন ডলার। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য যে কোনো দেশকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। এসব নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ইরান ও চীন। 

বিশ্লেষকরা বলেন, শুধু ডলারের জন্য বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে পারে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। কারণ ডলার দিয়েই হয় সব বাণিজ্য। ডলারের এই আধিপত্য ভাঙতে চায় রাশিয়া-চীন। ব্রিকস দেশগুলোকে নিয়ে একটি বিকল্প বাণিজ্যব্যবস্থা তৈরি করতে চায় তারা, যেখানে ডলার, ইউরো বা জি৭ দেশগুলোর মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে না। তখন আর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কাজে আসবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh