২০২৩ সালেও বিশ্বব্যাপী অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে আগের অতি ধনীদের সম্পদের পাহাড়ও আরো বিশাল হয়েছে। আলট্রাটা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর এই অতি ধনী মানুষের সংখ্যা ২০২২ বছরের তুলনায় ৭.৬ শতাংশ বেড়েছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির ওপর, যাদের সম্পদ তিন কোটি ডলারের বেশি। গত পাঁচ বছরে এ রকম ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালে তাদের সম্পদমূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। ওই বছর তাদের মোট সম্পদের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯.২ ট্রিলিয়ন বা ৪৯ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে, আলট্রাটার শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী, যাদের সম্পদমূল্য ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ ডলার, তারা হলেন ধনী। যাদের সম্পদমূল্য ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলারের বেশি, তারা অতি ধনী। আর বিশ্বের সবচেয়ে অতি ধনী অধ্যুষিত অঞ্চল উত্তর আমেরিকা। এই অঞ্চলে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে এ অঞ্চলে অতি ধনী মানুষ বেড়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বে যত অতি ধনী মানুষ আছে, তাদের ৩৭.৮ শতাংশের বসবাস এ অঞ্চলে। গত বছর ইউরোপে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। সেই তুলনায় এশিয়া অঞ্চলে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কম, মাত্র ৩ শতাংশ। গত বছর ইউরোপ বিশ্বের অতি ধনীদের বসবাসের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ শতাংশ অতি ধনী বসবাসকারীর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে অতি ধনীর সংখ্যা সোয়া ২ কোটি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৩ শতাংশ। নিউইয়র্কের সাড়ে ৩ লাখ বাসিন্দা অতি ধনী, যা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের অবস্থান এবং এ সংখ্যা ৬০ লাখ। অতি ধনীদের প্রায় ১৬ শতাংশের বসবাস চীনে। বিশেষ করে হ্যাংজো এবং শেনজেনের মতো অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অতি ধনীদের বসবাস বেশি। তবে গত এক বছরে চীনে অতি ধনী কমেছে ১ শতাংশ। ফ্রান্স ও জাপানে অতি ধনীর সংখ্যা ২৮ লাখের মতো। এরপরই আছে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। এই দুই দেশে অতি ধনীর সংখ্যা ২৬ লাখ করে। জার্মানিতে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে আছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও কোরিয়া। ভারতের অবস্থান ১৪তম।
সম্পদশালী ব্যক্তিরা যেসব দেশে বাস করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, সেসব দেশে প্রকৃত ধনীর সংখ্যা জানা নেই। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ। চীনে অতি ধনীর সংখ্যা কমলেও এশিয়ার অন্যান্য দেশ, যেমন জাপান ও ভারতে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত বাড়ছে।
আলট্রাটার প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের যে ১০টি শহরে সবচেয়ে বেশি হারে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়বে, তার মধ্যে তিনটিই হবে ভারতের। গত বছর বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই ছিল সবচেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরেও দেশটি উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ ও দিল্লির মতো শহরে প্রতি বছর গড়ে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ হারে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এ ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য শহরের মধ্যে ফিলিপাইনের ম্যানিলা ও মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে এগুলো থাকবে।
দাতব্য সংস্থা অক্সফামের মতে, বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণ দ্রুতই বাড়ছে। গত এক দশকেই তাদের সম্পদ বেড়েছে ৪২ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন ১ লাখ কোটি)। গড়ে প্রায় ৪ লাখ ডলার করে বেড়েছে প্রত্যেকের; যা বিশ্ব জনসংখ্যার নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে প্রায় ৩৪ গুণ। একই সময়ে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে গড়ে ৩৩৫ ডলার। অর্থাৎ গড়ে তাদের সম্পদ বেড়েছে দৈনিক ৯ সেন্ট করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর দিতে হতো। যার সম্পদ যত বেশি, তাকে তত বেশি কর দিতে হতো। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ করের হার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। যার অর্থ, একটি শ্রেণির হাতে বিশাল সম্পদ পুঞ্জীভূত হবে না। তবে ১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আঘাতে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র এক অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে। পরে সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এটিকে নব্য উদারনীতিবাদের দিকে ধাবিত করেন। রিগ্যান সর্বোচ্চ করের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেন। এতে ধনীদের হাতে আরো বেশি টাকা জমতে থাকে। অতি ধনী তৈরির ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রধান সংস্কার। অর্থিক খাতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব করে তা বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন কমে এসেছে; তেমনি বেড়েছে বৈষম্য। পরবর্তী সময়ে এই কাঠামো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয় মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh