তেল আবিবে কিংবা ওয়াশিংটনে- ক্ষমতায় যেই থাকুন না কেন, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ইস্পাত-আবরণে সুরক্ষিত থাকবেই। দুই দেশে গত কয়েক দশকে ক্ষমতার পালাবদল ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবলে এই চিত্রই ফুটে ওঠে। ফলে ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেনকে সরিয়ে হোয়াইট হাউসে কট্টরপন্থি রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এলেও ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার সমান- এখন বলা ভালো আরো বেশি সমুন্নত থাকছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে গিয়ে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন। নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর বিস্ময়কর এক ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি জানান, গাজার দখল নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার বাসিন্দাদের মিশর, জর্ডানসহ অন্যান্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেন তিনি। এরপর কয়েকবার তিনি এই ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণায় ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্যরাও হতবাক হয়ে পড়েন।
কিন্তু ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তববাদী? আদৌ কি তিনি সফল হবেন? বিবিসির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না। ট্রাম্পের বর্ণনা অনুযায়ী, গাজার বাসিন্দাদের স্থানান্তর ও সরিয়ে নেওয়ার কাজটির অর্থায়ন করবে সৌদি আরব। তবে বেশির ভাগ আরব দেশ এরই মধ্যে এই পরিকল্পনা নাকচ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররাও এই চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের স্থায়ী সমাধান হিসেবে দুই-রাষ্ট্র মতবাদের প্রতি নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। এরই মধ্যে ইরান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এতে নিন্দা জানিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের একটি অংশ সুযোগ পেলে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড ছেড়ে যেতে আপত্তি করবে না। ১০ লাখ মানুষ সরে গেলেও আরো অন্তত ১২ লাখ মানুষ সেখানে থেকে যাবেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা মোতায়েন করে বাকি বাসিন্দাদের জোর করে সরাতে হবে।
২০০৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সাধারণ মার্কিন জনগণের কাছে তেমন জনপ্রিয়তা পাবে না বলেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এ ধরনের উদ্যোগে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই চিন্তাধারায় মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের অন্তিম সমাধান হিসেবে ইসরায়েলের পাশাপাশি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে গাজা ও পশ্চিম তীরের সমন্বয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। নেতানিয়াহুর সরকার বরাবরই এই সমাধানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তবে নব্বইয়ের দশক থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উপকরণ হিসেবে চালু থেকেছে এই দুই-রাষ্ট্র নীতি। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন হবে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও তার বক্তব্যে একসময় অসম্ভব বলে বিবেচিত একটি অবাস্তব চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, এটাই নেতানিয়াহুর বড় পাওয়া। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই বক্তব্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ। তার যেকোনো বক্তব্য সারা বিশ্বের মানুষ গুরুত্ব সহকারে নেয়। স্বল্প মেয়াদে তার ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি আরব রাষ্ট্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে ‘ভঙ্গুর’ হিসেবে বিবেচিত গাজার যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে। এখন এই সমস্যার একটি সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন ট্রাম্প, হামাস বা ইসরায়েল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকবে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা প্রভাবিত হবেন।
কিন্তু ফিলিস্তিন এখন কী করবে? ট্রাম্পের বদ-মতলব মেনে নেবে? না। ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন উপত্যকাটির স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মুখপাত্র ওসামা হামদান। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কয়েক দশক ধরে চলা এই প্রচেষ্টা ছেড়ে দেবে না। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কাছে এটি পৌঁছে দেয়, তবে ভালো। যদি না হয়, তবে তারা প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ১৯ জানুয়ারি থেকে মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়েছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh