ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ও অস্ত্র বাণিজ্যে ঘায়েল মোদি

আগে থেকেই ব্যাপক প্রচারণা ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফর নিয়ে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে মোদি সমর্থকরা এটিকে মোদির গভীর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও ব্যবসাবান্ধব নীতির প্রতিফলন বলে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টো। পরিপক্ব ব্যবসায়ী ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করেন। ভারতের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাধ্যতামূলক জ্বালানি ক্রয়সহ ভারতে ব্যয়বহুল সমরাস্ত্র বিক্রিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন মোদি। 

মোদি এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন এমন সময়ে যখন ট্রাম্প আদেশ দিয়েছেন, মার্কিন বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর পারস্পরিক শুল্ক প্রয়োগ করা উচিত। অর্থাৎ যেসব দেশ মার্কিন রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ করে, তাদের ওপরও একই রকম শুল্ক প্রয়োগ করা হবে। এটি ১ এপ্রিলের মধ্যে কার্যকর হতে পারে। ভারত তার শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করে। ট্রাম্পের শুল্ক পদক্ষেপের আগাম ব্যবস্থা হিসেবে ভারত তার কেন্দ্রীয় বাজেটে গড় শুল্ক ১৩ থেকে ১১ শতাংশে কমিয়েছে। দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, তিনি শুল্ক নিয়ে কোনো ‘সমস্যা দেখছেন না’। মার্কিন রপ্তানির ৭৫ শতাংশ পণ্যের ওপর ভারত ৫ শতাংশের কম শুল্ক আরোপ করে। ট্রাম্প কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর ১৫০ শতাংশের মতো চরম শুল্কের কথা বলেছেন, কিন্তু এটি সাধারণ নিয়ম নয়। ভারতের পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে ভারতীয় বৈদেশিক বাণিজ্য ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর ডব্লিউটিও স্টাডিজের সাবেক প্রধান অভিজিৎ দাস এতে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, বিষয়টি বিস্তারিত জানার ওপর নির্ভর করে। পারস্পরিক শুল্ক শুধু ভারতের আমদানি শুল্কের প্রতিফলন নয়; অন্যান্য বিষয়ও এতে ভূমিকা রাখবে। ট্রাম্পের পদ্ধতি আমদানি শুল্কের বাইরেও যেতে পারে, যেখানে ভ্যাট, অশুল্ক বাধা এবং বাণিজ্য বিধিনিষেধ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যদিও ভারতের আমদানীকৃত পণ্যের ওপর আরোপ করা কর ডব্লিউটিও নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; তবুও ট্রাম্প এটি উচ্চশুল্কের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।

পারস্পরিক শুল্ক সম্পর্কে একটি মার্কিন সরকারি মেমো এই কৌশলের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে অশুল্ক বাধা, ভর্তুকি এবং বিদেশে মার্কিন ব্যবসায়ীদের খরচের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ভ্যাট এবং সরকারি ক্রয় সীমাবদ্ধতাকেও অশুল্ক বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে ভারতের স্থানীয় উৎপাদকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হবে, যা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। 

নতুন ৫০০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে ১৯০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের দ্বিগুণেরও বেশি। মোদি ও ট্রাম্প ২০২৫ সালের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির প্রথম ধাপ নিয়ে আলোচনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। আলোচনায় বাজার উন্মুক্ত করা, শুল্ক হ্রাস এবং পণ্য ও সেবা নিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলা সংহতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারত এতদিন রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে অপরিশোধিত তেল কিনেছে। চুক্তি অনুসারে এখন সেই তেল-গ্যাস কিনবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেক বেশি দামে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য প্রায় শূন্য থেকে বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারীতে পরিণত করেছে। যদিও ভারতের শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে রয়েছে রাশিয়া, তার অংশীদারি ৬২ থেকে ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে (২০১৭-২০২৩), কারণ  যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের দিকে ঝুঁকছে ভারত। প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গভীর করতে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই বছর থেকে ভারতে অনেক বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বাড়াবে, যা পরবর্তী সময়ে এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান সরবরাহের পথ প্রশস্ত করবে। তবে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ‘এটি শুনতে ভালো লাগলেও এটি গাড়ির আগে ঘোড়া কেনার মতো হতে পারে। ভারতের কাছে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি বাড়লেও আমলাতান্ত্রিক বাধা এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সংবেদনশীল প্রযুক্তি স্থানান্তরকে সীমিত করতে পারে। শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষিত নতুন প্রতিরক্ষা কাঠামো এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে।’

বিশ্লেষকদের মতে, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্রয় করা ভারতের জন্য লাভবান হবে না। তবে ট্রাম্প অনেকটা জোর করেই এই ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমান বিক্রির কথা ঘোষণা দিয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকাও প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তিনি। সব মিলিয়ে মোদি এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে ট্রাম্পড হয়েছেন। ঘায়েল হয়েছে ভারতের অর্থনীতি ও কূটনীতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh