Logo
×

Follow Us

Unknown

তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনে রোজার ভূমিকা

Icon

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:২৭

তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনে রোজার ভূমিকা

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)

তাকওয়ার অর্থ হলো- আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের শাস্তিকে ভয় করে সতর্কতার সাথে জীবনযাপন করা। 

তাকওয়ার আরো সহজ অর্থ হলো- সতর্কতা, সাবধানতা, আত্মরক্ষা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য হলো মানুষের মানবীয় গুণাবলির শত্রু। যেসব গুণ বা  বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্থ করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু। মানুষের মধ্যে এরূপ ছয়টি রিপু বা শত্রু রয়েছে। এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। অধঃপতনের অতলে নিমজ্জিত করে। রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন করা।

মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিদায়াত। আল্লাহ রব্বুল আলামিন সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন, ‘আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ পারা কোরআন নাজিল করা হয়। এই জন্যই সুরা ফাতিহাকে ‘উম্মুল কোরআন’ বা ‘ কোরআন জননী’ বলা হয়। হিদায়াতের পূর্বশর্ত হলো তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা বললেন,‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত। সঠিক সরল পথনির্দেশ’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।

একজন প্রকৃত মোমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে ও সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘যারা ইমান আনল ও তাকওয়া লাভ করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াতে: ৬২)। 

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল’ (সুরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৯)। 

রমজান হলো তাকওয়া বা আত্মশুদ্ধির জন্য অনুকূল ও সহায়ক। তাকওয়া বা পরহেজগারীর শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে রোজার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। যার মধ্যে এ শক্তি সৃষ্টি হবে তাকে বলা হয় ‘মুত্তাকি’। 

মুত্তাকিদের উদাহরণ দিতে গিয়ে উবাই বিন কাব (রা)  উমরকে (রা.) বলেছিলেন, ‘কাটাযুক্ত ও সংকীর্ণ রাস্তায় খুব সতর্কতার সাথে যেমন চলতে হয় তাই হচ্ছে তাকওয়া।’ বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা আবু লাইস সমরকন্দি (রহ.) তার ‘তাম্বিহুল গাফেলিন’ নামক কিতাবে লিখেছেন, ‘প্রকৃত খোদাভীতি হলো দৃষ্টিকে অবৈধ দৃশ্য থেকে ফিরিয়ে রাখা এবং জিহ্বাকে মিথ্যা ও গিবত থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহকে হারাম কাজ থেকে বিরত রাখা।’ 

রোজার মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়ার প্রভাব মুমিনের গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যার ফলে সে কখনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। খাবারের চাহিদা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রোজা পালনকারী স্বীয় প্রবৃত্তির ঘোড়াকে লাগামবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ (বুখারি : ১৯০৪)। ঢাল যেমন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধাকে শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা করে, রোজাও তেমনি বান্দাকে শয়তানের প্রবঞ্চনা ও কুপ্রবৃত্তির প্ররোচনা থেকে রক্ষা করে। এতে বান্দার ঈমান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। 

মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে ও স্বীয় প্রবৃত্তিকে রিপুর অনুসরণ থেকে বিরত রাখে তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ (সুরা নাযিআত : ৪০-৪১)

রোজা চরম খাদ্য বিলাসীকে সংযমী করে তোলে। পেট যখন ভরা থাকে তখন অন্যের ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করা যায় না। জিহ্বা যখন পানিতে ভেজা থাকে তখন অন্যের পিপাসার কষ্ট অনুভব করা যায় না। সর্বক্ষেত্রে রোজার মাধ্যমে আত্মসংযম ও সবরের শিক্ষা পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম সবরের অর্ধেক আর সবর ইমানের অর্ধেক।’ (কিমিয়ায়ে সাআদাত : ২০৯)

রাসুল (সা.) বলেছেন,‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি : ১৯০৩)। 

অর্থাৎ রোজা পালনকারী হাদিস মতে, এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত হলে সে কিছুই পেল না সিয়াম থেকে। আর যদি বান্দা এসব থেকে বিরত থাকতে পারে তাহলে ধরে নেয়া যায়, বান্দা তাকওয়ার স্তরে উন্নীত হয়েছে। আর তাকওয়াই হচ্ছে জান্নাত লাভের অপরিহার্য শর্ত। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে জান্নাতের উত্তরাধিকারী আমি অবশ্যই তাদেরকে বানাবো, আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী।’ (সুরা মরিয়ম : ৬৩)

তাই আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার গুণসম্পন্ন মুত্তাকি সৃষ্টির জন্য রমজান মাসের সিয়াম সাধনা অপরিহার্য করেছেন।  কেননা মাহে রমজানের রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। রমজান মাসে রোজাদার তাকওয়া ভিত্তিক চরিত্র গঠনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। যিনি মুত্তাকী বা পরহেজগার হবেন, তিনি যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন ও ভালো কাজের অনুশীলন করবেন।

বছরের এক মাসব্যাপী রোজা পালনের উদ্দেশ্যে নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। মানুষের মধ্যে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

রোজাদার ব্যক্তি রোজা আছে কি না, তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সামনে সুস্বাদু ও লোভনীয় খাবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের কারণে সে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কোনো রোজাদার যদি লোক চক্ষুর অন্তরালে কোনো খাবার ভক্ষণ করেন বা কিছু পালন করেন বা নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে বসেন, তাহলে তা মানুষের জানার নয়। কিন্তু খাঁটি রোজাদার ব্যক্তি তা করেন না। কারণ, সেই মুত্তাকী। আর তিনি জানেন যে মানুষ না দেখলেও আল্লাহ তার বান্দার সব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছেন। এভাবে রোজাদারের মাঝে খোদাভীতি সৃষ্টি হয় ও সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, যাবতীয় অশ্লীল কাজ, মিথ্যা কথা প্রভৃতি খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। তাই রোজাকে বলা হয় তাকওয়া অর্জনের মাস। 

রোজা মুত্তাকীর জন্য এক অফুরন্ত নেয়ামত স্বরূপ। নবী কারীম (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি মাহে রমজানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা সুচারুভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফফারা হয়ে যাবে। (বায়হাকি)।

একজন রোজা পালনকারী ও তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুসলমান সমাজে কোনো প্রকার অশ্লীল ও খারাপ কাজ করবেন না, কারও অনিষ্ট সাধনের চিন্তাও করবেন না, বরং সর্বদা পরোপকারে লিপ্ত থাকবেন এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক জীবনযাপন করে জান্নাত লাভের পথ সুগম করবেন। 

এখন থেকেই যদি আমরা তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে চলি, মানুষ হিসেবে মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন হই, আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলি, সমাজের অন্যায় ও অকল্যাণের পথ বর্জন করে চলি, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা মুত্তাকী হতে পারবো। আমিন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫