
ক্ষমা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস পবিত্র রমজান। আমরা রমজানের প্রথম দশকে আছি। রহমতের দশক। আমাদের উচিত মাহে রমজানের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগানো। নেক আমল দ্বারা ভরপুর করে ফেলতে পারি যেন আমাদের জীবন সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
রমজানে রাসুল (সা.) এর আমলগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রমজান এলে রাসুল (সা.) এর দানের মাত্রা বেড়ে যেত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত, ‘রমজান এলে রাসুল (সা.) দানের হাতকে আরো বেশি প্রসারিত করে দিতেন।’
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এর দানের হাত এতটা প্রসারিত ছিল যে, সকাল বেলা যদি ওহুদ পরিমাণ সম্পদও রাসুল (সা.) এর কাছে রাখা হয়, আমার মনে হয়, মাগরিব আসার আগেই তিনি সব দান করে শেষ করে ফেলবেন। (বুখারি ও মুসলিম)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেতো।’ (সহিহ মুসলিম)।
দান-সদকা ক্ষমারও বড় কারণ। দান সদকা করলে আল্লাহতায়ালার দরবার থেকে ক্ষমা পাওয়া যায়।
‘সদকা’ এর অর্থ ব্যাপক। অর্থ দিয়েও সদকা করা যেতে পারে। আবার কারও সাথে হাসিমুখে কথা বললে কিংবা কাউকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েও সদকা করার অংশীদার হওয়া যায়।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি সদকা।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)।
রমজানের দান-সদকার সওয়াবও অনেক বেশি। গরিব-দুঃখীদের জন্য সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে সওয়াব অর্জনের সর্বোত্তম সময় রমজান। সদকা মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে। মহানবী (সা.) বলেন, পানি যেমন আগুনকে নিভিয়ে দেয় নিশ্চয় তেমনি সদকাও কবরের আজাবকে নিভিয়ে (বন্ধ করে) দেয়(তিরমিজি)। তাই তো রসুলে করিম (সা.) বলেন, তোমরা খেজুরের সামান্য অংশ সদকা করে হলেও নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)।
কেউ যদি অভাবীদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে, তা যত কম অথবা ছোটই হোক না কেন আল্লাহর কাছে তা খুবই প্রিয়। অভাবী মানুষকে খাবার প্রদান করা একটি উত্তম সদকা।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, এক লোক নবীজী (সা.) কে প্রশ্ন করলো, ‘ইসলামের কোন কাজটি উত্তম?’ নবীজী (সা.) বললেন, ‘কাউকে খাবার খাওয়ানো...।’ (বুখারি)। পক্ষান্তরে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যারা অভাবীদের জন্য খাবার পানীয় নিয়ে এগিয়ে আসবে না তাদের জন্য আল্লাহর দয়া সংকুচিত হয়ে আসবে। নবীজী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হয় না। ( তিরমিজি)। অভাবী প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্থ রেখে যে ব্যক্তি উদরপূর্তি করে খায় রসুলে করিম (সা.) তাকে কঠিন ভাষায় সতর্ক করেছেন। এমনকি ‘সে মুসলমান নয়’-এমন কঠিন ভাষাও তিনি প্রয়োগ করেছেন। রসুল (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি মুমিন নয় যে তার প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্থ রেখেও পেট ভরে খায়।’ (সুনান আল কুবরা)।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সওয়াবের আশায় কোনো মুসলিম যখন তার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করে তা সদকা হিসেবে গণ্য হয়। মুসলিম)। অপর হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘একটি দিনার তুমি জিহাদের জন্য খরচ করেছ, একটি দিনার দাস মুক্তির জন্য ব্যয় করেছ, একটি দিনার একজন নিঃস্বকে দান করেছ ও একটি দিনার নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এগুলোর মধ্যে সওয়াবের দিক থেকে সর্বাধিক বড় হলো যা তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। ( মুসলিম)।’
রমজান মাসে যখন হযরত জিব্রাইল (আ.) নিয়মিত আসতে শুরু করতেন, তখন তার দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত (বুখারি)।
আনাস (রা.) বলেছেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-এর চেয়ে কাউকে অধিকতর দয়ালু দেখিনি।’ (মুসলিম)
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ পাক বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান করতে থাকো, আমিও তোমাকে দান করব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অন্য ১১ মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক দান-সাদকা করা উচিত। রাসুল (সা.) তাঁর উম্মতদের বাস্তব শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রমজান মাসে দান-দক্ষিণা ও বদান্যতার হাত বেশি করে প্রসারিত করতেন। এ মাসটিকে তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি মাহে রমজানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন। প্রত্যেক সাহায্যপ্রার্থী দরিদ্রকেই তিনি দান করতেন। এ সময় কেউ তাঁর কাছ থেকে বঞ্চিত হননি।
যে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতি সৃষ্টি হলো না, দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলি তৈরি হলো না, তার রোজা পালন নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। তাই যে ব্যক্তি শুধু রোজা পালন করে, কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষায় এগিয়ে আসে না, সমাজের গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণ তথা দারিদ্র্য বিমোচনে হাত সম্প্রসারণ করে না, সে ব্যক্তি রমজান মাসের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়। আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে দান-সাদকা করে সে সাধারণ সময়ের দানের চেয়ে বহুগুণ বেশি সওয়াব পাবে।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রমজান মাসে এক দিরহাম দান-খয়রাতের বিনিময়ে সহস্র দিরহামের পুণ্য লিপিবদ্ধ করা হয় (বুখারি)।’
দানের ব্যাপারে শুধু টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভর করে না, তা মানুষের মনের ওপর নির্ভর করে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আত্মার অভাবমুক্তিই হচ্ছে আসল অভাবমুক্তি।’ (বুখারি)
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) বর্ণিত, ‘নামাজ মানুষকে আল্লাহর পথে অর্ধেক পৌঁছে দেয়। রোজা তাকে আল্লাহর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছায়। আর দান-খয়রাত তাকে খোদ আল্লাহর ঘরে পৌঁছে দেয়”(বুখারি)। জান্নাতে প্রবেশের জন্য দানশীলতা একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ। রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি নফল কাজের সওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেন। সে হিসাবে রমজানে এক টাকা দান করে ৭০ টাকা দানের সওয়াব লাভ করা সম্ভব।
তাই আমাদের উচিত রমজানে দান-সদকার নেকিতে নিজের জীবনকে ভরপুর করতে নিজের সাধ্য অনুযায়ী অনাথ, আর্ত, অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য দানের হাত বাড়িয়ে দেয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বেশি বেশি দান-সদকা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।