
বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২-১০৫৪) একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে স্বীকৃত। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কারে তার অবদানের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। ‘বোধি পথ প্রদীপ’, ‘সত্যদ্বয় অবতার’, এবং ‘কর্ম বিভঙ্গ প্রকরণ’ প্রমুখ অতীশের রেখে যাওয়া সুবিশাল সাহিত্য কীর্তি ছাড়াও তার জীবন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় আছে অনেক বিষয়। এই প্রবন্ধে অতীশের জীবনিকারদের দ্বারা বিশেষভাবে উল্লিখিত তার বিশেষ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করা হবে।
আদর্শ শিক্ষার্থী
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে অতীশ যে কারণে বিশিষ্ট, সেটি হলো- তার অদমনীয় জ্ঞান পিপাসা। তিনি কিশোর বয়স থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত জ্ঞানসাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেকালে প্রচলিত ধর্মীয় সব মতামত তিনি গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেন। হীনযান, মহাযান, বজ্রযান মতবাদের বিশেষ করে যোগাচার এবং মাধ্যমিকাদি দর্শনের খ্যাতনামা সকল গুরুগণের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। ব্যাকরণ, গণিত, এবং বাংলার দোহা সাহিত্যেও তার জ্ঞান ছিলো গভীর।
এই জ্ঞান পিপাসা তাকে নিয়ে যায় সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। সমুদ্রপথে বেশ কয়েক মাস ধরে যাত্রার সময় তুফান ও ঝড়ে অতীশের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়েছিলো। ছাত্রাবস্থায় অতীশ প্রায় ১৫৭ জন গুরু বা আচার্যের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন বলে তার তিব্বতি জীবনীকাররা উল্লেখ করেছেন।
এ থেকেই বোঝা যায়, জ্ঞান অন্বেষায় অতীশ ছিলেন নিরলস ও কঠোর পরিশ্রমী, বিপদসংকুল পরিবেশে ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, এবং গুরুর সান্নিধ্যে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। এসব গুণাবলী অতীশকে বিশিষ্টই করেনি, করেছে অনুকরণীয়ও।
জনকল্যাণে নিবেদিত
অতীশ যখন তিব্বতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রিত হন তখন তার সাতান্ন বছর বয়স। হিমালয় পর্বত পেরিয়ে তৎকালীন বঙ্গ থেকে তিব্বত যাওয়ার রাস্তা ছিলো খুব বিপদসংকুল। সম্পূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে নেপাল হয়ে তিব্বত পৌঁছাতে সময় লেগেছিলো পুরো একটা বছর। এই সময় তাকে সঙ্গী করে নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় এবং দস্যুদের হাতে আহত ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সুস্বাস্থ্য সম্পন্ন যুবকদের জন্যও যে ভ্রমণ বিপদ সংকুল ছিলো, অতীশ সাতান্ন বছর বয়সে সেই পথ পাড়ি দিতে সাহস করেছিলেন।
তার আচার্য এবং কল্যাণ মিত্র অনেকেই অতীশকে বাঁধা দিতে চেয়েছিলেন। অতীশ নিজেও জানতেন এই ভ্রমণের কারণে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে নিশ্চিত। হয়েছিলোও তাই। তারপরও তিনি কোনো প্রকার বিপদ বা অনুৎসাহমূলক বাক্যের দ্বারা পিছপা হননি। নিজ সিদ্ধান্তে ছিলেন দৃঢ়। এর কারণ তিনি জনকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তিব্বতের রাজা তাকে বার বার নিমন্ত্রণ করছিলেন সেখানে ক্ষীয়মাণ বৌদ্ধ ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। অতীশের বিবেক এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে সায় দেয়নি।
ব্যক্তিত্বের ঋজুতা
অতীশ তিব্বত যাওয়ার পর প্রথমে ছিলেন ঙ্গারি অঞ্চলে। সেখানে নাকি একসময় হ্লাসা থেকে কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু তাকে দেখতে আসেন। তাদের উদ্দেশ্য- অতীশকে নিমন্ত্রণ করে হ্লাসায় নিয়ে যাবেন; কিন্তু তাদের পরিধানে ছিলো রাজকীয় পোশাক। তারা এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে। তারা অতীশের জন্য আসলেও অতীশ তাদেরকে দূর থেকে দেখেই সাক্ষাৎ করতে নারাজ হন। হ্লা সার ভিক্ষুগণ আকস্মিক এই প্রতিক্রিয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
পরে তাদেরকে যখন বৌদ্ধ ভিক্ষুর যথাযথ কাপড় পরিধান করে আসতে বলা হলো, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং অতীশের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেন। অতীশ এই আগন্তুকদের অবমাননা করেননি, বরং তাদের এই বাহ্যিক পোশাকের কারণে যে অহংকার প্রকাশ পেয়েছে, সেটিকেই দেখিয়ে দিয়েছেন। এর দ্বারাই বোঝা যায়- অতীশ বিত্ত বাহারি পোশাকে যারা দম্ভ করেন, তাদেরকে প্রশ্রয় দেননি। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের ঋজুতা ছিলো বলেই অতীশ এটা করতে পেরেছেন। শিষ্যদেরও তিনি বার বার সহজ সরল নিরহঙ্কার জীবন-যাপন করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
নম্রতা
তৎকালীন ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন অতীশ। তারপরও তিনি তার দেশ না শুরু করার আগে বলতেন- ‘যেসমস্ত জানার বিষয় আছে, সে তুলনায় আমার জ্ঞান অত্যন্ত তুচ্ছ। আপনারা যে আমাকে দেশ না করতে বলছেন এটি অনুচিত। আপনাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক উচ্চ এবং চিন্তাপ্রখর- তারপরও প্রিয় বন্ধুগণ, যেহেতু আপনারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, আমি দুয়েকটা কথা বলে যাবো।’
এভাবে তিনি তার শ্রোতা এবং শিষ্যদের অত্যন্ত সম্মান দিয়ে দেখতেন। তাদের চিন্তার স্বকীয়তা এবং প্রখরতাকেও সমীহ করতেন। সর্বোপরি সবাইকে নিজের শিষ্যের চেয়েও বেশি বন্ধু হিসেবেই দেখতেন। নিজের শিষ্যদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। অতীশ তার শিষ্যদের বলতেন- তারা যেন নীচ বলে কাউকে অবজ্ঞা বা অপমান না করে, বা আঘাত প্রাপ্ত না করে, বরং যেন ভালোবাসে।
সকল প্রকার বৈরিভাব এবং পক্ষপাতিত্ব ত্যাগ করে যেন সবার সঙ্গেই মৈত্রীর চর্চা করে। নিজের পুণ্য সঞ্চয় অন্যের চেয়ে বেশি- এই বলে যেন দম্ভ না করে। অন্যের ভুল নয়, বরং গুণগুলো যেন অনুকরণ করে এবং নিজের গুণগুলোর কথা প্রচার না করে, দোষগুলো যেন সংশোধন করে। এভাবে অন্যকে সম্মান করে তাদেরকে যেন সেবা করে।
একনিষ্ঠচর্চা
অতীশের নিজের লেখায় এবং শিষ্যদের স্মৃতিচারণে জীবনের অনিত্য ও দুর্লভ তাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে একনিষ্ঠভাবে চিত্তের উৎকর্ষ সাধন ও পরহিতকামী বোধি চিত্তের চর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য জোর দেয়া হয়েছে। অতীশ বলেন- ‘এই সময়কে কলিযুগ বলা হয়। এখন শুধুমাত্র হেসে-খেলে সময় পার করা ঠিক নয়। এখন উদ্যমী হওয়ার সময়। এখন উঁচু উঁচু পদ বিনিয়ে বসে থাকার সময় নয়, নিরহঙ্কারী হওয়ার সময়।
এখন ভিরের মধ্যে নয়, আত্মবীক্ষণের জন্য একাকী নির্জনতায় বাস করারস ময়। প্রচুর শিষ্যের অনুসারী হওয়ার চেয়ে নিজেকে সৎ পথে যথাযথ পরিচালিত করার সময়। এখন শুধু শাস্ত্রের বাণী নিয়ে পড়ে থাকার সময় নয়, এখন সেগুলোর গভীর তাৎপর্যের উপর ধ্যান করার সময়। এখন দুর্বল হয়ে বা হেলিয়ে পড়ার সময় নয়, এখন ঋজু ও দৃঢ় হওয়ার সময়।’ তিনি আরো বলেন- ‘এমনভাবে জীবন পরিচালনা করতে হবে, যাতে মৃত্যুর সময় কোনো লজ্জাজনক কাজের জন্য অনুতাপ করতে না হয়।’এমনকি নয়া পাল নামে তার এক বন্ধু, যে ছিলেন মগধের রাজা, তাকেও চিঠিতে অতীশ বলেছিলেন- কাজের শেষে তিনি যেন নির্জনতায় আশ্রয় নেন। ‘একটি মৃত পশুর শরীর যেমন জনগণের অলক্ষ্যে গভীর বনে পড়ে থাকে, নিজের অহংবোধ বা আমিত্বও যেন সেভাবে লুকানো থাকে।’
সাম্য-প্রতিষ্ঠা
অতীশের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি কঠিন দার্শনিক বিষয়কে অত্যন্ত সহজ করে উপস্থাপন করতে পারতেন। তিনি নাগার্জুন বা অসঙ্গের মতো কোনো মৌলিক দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেননি। তারপরও ইতিহাস যে কারণে তাকে স্মরণ রেখেছে সেটি হলো- তিনি বিভিন্ন বৌদ্ধ মতবাদগুলো এক করে একটি পরিপূর্ণ নকশা তৈরি করতে পেরেছিলেন। হীনযান, মহাযান, বজ্রযান ইত্যাদি মতবাদকে অবলম্বন করে অনেকেই একে-অপরের মধ্যে তর্কে লিপ্ত ছিলেন। কোনটি উত্তম বা শ্রেয়তর সেটা নিয়েও ছিলো সংশয়।
অনেকেই মানব মনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে, নিজ নিজ মতবাদে আসক্ত হয়ে পড়েন। প্রজ্ঞা, মৈত্রী, করুণার চর্চার চেয়ে নিজ মতের পক্ষে এবং পরমতের বিপক্ষে বিতর্ক করেই মূল্যবান সময় পার করেন। অতীশ বিরুদ্ধ মতবাদগুলোর মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্বন্ধগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে সাম্যভাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের অনুসারীদেরও একটি কার্যকর দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন। তারই প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ইতিহাসে সাক্ষর করে নিয়েছে অতীশের অমরসৃষ্টি ‘বোধি পথ প্রদীপ’। এবং এই গ্রন্থের উপর নির্ভর করেই তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের চর্চায় একটি নতুনযুগ সূচিত হয়। তাই অতীশের মৃত্যুর প্রায় আটশ’ বছর পরেও তিব্বতের জাম্যং খ্যেন্সে ছক্যি লোড্রো নামের এক পণ্ডিত অতীশকে বন্দনা করেন এভাবে-
নিঃসৃত হয়ে অমিতাভ বুদ্ধের চিত্ত হতে,
হে অতীশ, পদ্মসম্ভবের সাক্ষাৎরূপ তুমি।
অনুপম তোমার কৃপায় হিমালয় দেশ তিব্বতে,
হে দীপঙ্কর, তোমার শ্রীচরণে আমি নমি।
লেখক: গবেষক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা