Logo
×

Follow Us

প্রবাস

সৌদি আরবে কঠিন দিন বাংলাদেশিদের

Icon

আনছার আহাম্মদ

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২০, ০৮:৪৯

সৌদি আরবে কঠিন দিন বাংলাদেশিদের

একসময় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে সৌদি আরব ছিল ‘পরশ পাথর’। একবার দেশটিতে যেতে পারলে পেট্রো-ডলার কামিয়ে জীবনের সব মুশকিল আসান! সৌদি আরব আর সেই ‘সোনার লঙ্কা’ নেই। সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের এখন কঠিন দিন চলছে। তেলসমৃদ্ধ মরু দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশির আয়ে। দুই দেশের দালালচক্র এবং কঠোর হওয়া আইন বাংলাদেশিদের আরো কঠিন অবস্থায় ফেলেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে সৌদির মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়। এই তিন শহরে অসংখ্য বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের, যারা ধনী দেশটিতে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন। যাদের অনেকেই বেকার। আবার অনেকের চাকরি থাকলেও নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। 

জেদ্দা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি শেখ আনোয়ার ২৮ বছর আগে সৌদি আরবে যান। তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তারই রাজনৈতিক সহকর্মী সিলেটের রুহেল মিয়া। তিনি দেশটিতে রয়েছেন ৩১ বছর ধরে। বছর তিনেক আগেও দুটি রেস্টুরেন্ট এবং একটি কাপড়ের দোকানের ‘মালিক’ ছিলেন রুহেল মিয়া। এখন কিছুই নেই। ট্যাক্সি ক্যাব চালিয়ে কোনো মতে টিকে আছেন সৌদিতে। 

রুহেল মিয়ার ছেলে ইমরান গত বছর সৌদি আরবে গেছেন। তিনি বাবার সঙ্গে ক্যাব চালান। রুহেল মিয়া জানান, সৌদিতে আর আগের দিন নেই। বিশেষ করে যারা গত পাঁচ-সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে এসেছেন তাদের অবস্থা খুব খারাপ। বহু বাংলাদেশির বৈধ ওয়ার্ক পারমিট (আকামা) নেই। আকামা থাকলেও যে কাজের জন্য সৌদিতে এসেছিলেন, সেই চাকরি নেই। অবৈধ হয়ে পড়েছেন। লুকিয়ে কাজ করেন। সবসময় থাকেন ধরপাকড়ের আতঙ্কে। চার থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে এসে ১৫/২০ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করছেন। থাকা-খাওয়াতেই তা শেষ। দেশে ফেরার সময় কপর্দকশূন্য পকেট!

বাংলাদেশিরা জানালেন, এই অবস্থা দুই কারণে। প্রথম কারণ, সৌদি সরকারের নীতিতে পরিবর্তন। অর্থনৈতিক চাপে থাকা আরব দেশটি বিদেশি কর্মী কমাতে চায়। ২০৩০ সালের মধ্যে সবখাতে দেশি কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সৌদি সরকার। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ব্যক্তি মালিকের অধীনে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের আকামা নবায়নে মাসে ৮০০ রিয়াল পর্যন্ত কর (রছুম) দিতে হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে বেশি সংখ্যায় কর্মী কাজ করে, সেখানে কর্মী প্রতি ৪০০ রিয়াল পর্যন্ত দিতে হয়। দেশটির আইনানুযায়ী, বিদেশি কর্মীকে একজন সৌদি নাগরিকের অধীনে থাকতে হয়। ওই নাগরিকই কর্মীর কফিল। 

দ্বিতীয় কারণ হলো, বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠাতে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট। বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সৌদির দালালদের কাছ থেকে আকামা কিনে কর্মী পাঠাচ্ছে। স্বপ্নে বিভোর এসব নতুন কর্মীরা এসে পড়ছেন অথৈ সাগরে। চাকরি না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে।

শেখ আনোয়ার নিজেই ‘জোনাকি এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক। তিনি জানালেন, ভিসা কেনাবেচা আইনত দ-নীয় অপরাধ হলেও বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠায় ভিসা কিনে। সৌদি আরবে কর্মরত কর্মীরাও ভিসা কিনে দেশ থেকে আত্মীয় স্বজনদের আনেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে একজন সৌদি নাগরিককে (কফিল) টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে চাহিদাপত্র নেয়া হয়। বলা হয়, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাসায় কর্মী প্রয়োজন। এ চাহিদাপত্রে একজন কর্মী প্রথমে ৯০ দিনের ভিসায় সৌদি যায়। তারপর কফিলের অধীনে তিনি আকামা পান। যা প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। 

জনশক্তি ব্যবসায় সম্পৃক্তরা জানালেন, প্রায় প্রতিটি চাহিদাপত্র কেনাবেচা হয়। একসময় ৭ থেকে ১৫ হাজার রিয়ালে (দেড় থেকে তিন লাখ টাকা) কেনাবেচা হতো। এখন তা বাংলাদেশি টাকায় এক থেকে সোয়া লাখ টাকায় কেনাবেচা হয়। চাকরি দেয়ার নামে কফিল শুরুতেই এ টাকা ঘুষ বাবদ নেন। আইনানুযায়ী, আকামা নবায়নের কর কফিলকে দিতে হবে। কিন্তু ভিসা কেনা সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের ক্ষেত্রে তা উল্টো। 

কারণ, যে কফিলের চাহিদাপত্রে বাংলাদেশি কর্মীরা সৌদি যাচ্ছেন, আসলে তার কর্মীর প্রয়োজন নেই। যে চাকরির কথা বলে তাকে আনা হয়েছে, তার অস্তিত্ব নেই। তাই কফিলের কাছ থেকে বেতন পাওয়ার সুযোগও নেই। নিজেকেই কাজ জুটিয়ে নিতে হয়। কফিলের চাকরি দেওয়ার সক্ষমতা আছে কী না, তা যাচাই করে বাংলাদেশ দূতাবাসের চাহিদাপত্র সত্যায়ন করার কথা থাকলেও, তা ঠিকভাবে হয় না। 

ভিসা কিনে সৌদি আরবে আসা লাখো বাংলাদেশিদের একজন ফরিদপুরের আরিফ হোসেন। তিনি জানালেন, গ্রামের দালাল ধরে তিনি সৌদি আসেন চার লাখ টাকা দিয়ে। তাকে বলা হয়েছিল ‘ফিদ্ধ ভিসায়’ পাঠানো হচ্ছে। যে কোনো চাকরি করতে পারবে। কিন্তু সৌদির আইনে ‘ফিদ্ধ ভিসা’ বলে কোনো বস্তু যে নেই, তা জানা ছিল না আরিফের।

পবিত্র শহর মক্কার মিজফালাহতে কাবা শরিফের অবস্থান। এ এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের প্রায় ৯৯ শতাংশ বাংলাদেশি। তাদের মাসিক বেতন মাত্র ৮০০ রিয়াল (১৮ হাজার টাকা)। ছয় লাখ টাকা খরচে তিন বছর আগে সৌদি আরবে এসে কুমিল্লার লাকসামের ইব্রাহিম মিয়ার সবেমাত্র খরচ উঠেছে। বাড়িতে পাঠাতে পেরেছেন লাখ চারেক টাকা। কিন্তু যারা এক দেড় বছর ধরে এসেছেন, তারা না দেশে ফিরতে পারছেন, না এত কম বেতনে চাকরি করতে পারছেন । 

সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানান, অধিকাংশ কর্মী নানা সমস্যায় রয়েছেন। বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের অবস্থা বেশি খারাপ। সেডর গ্রুপের উদাহরণ দিয়ে বললেন, প্রতিষ্ঠানটিতে ৩২ হাজার বাংলাদেশি পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করতেন। আগে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি দলে একজন সুপারভাইজারের অধীনে ১৬ কর্মী থাকত। অটোমেশনের পর ছয়জন কর্মী লাগছে। কাজের সুযোগ কমে গেছে। 

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত বছর সৌদি আরবে ৩ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশি গিয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গিয়েছেন ৫১ হাজার ৭৮৬ জন। নতুন করে যারা যাচ্ছেন, তাদের কেউ তিন লাখ টাকা কমে দেশটিতে যেতে পেরেছেন, এমন একজনের দেখা পাওয়া যায়নি মদিনা, মক্কা, জেদ্দায়। 

আরাফাত ময়দানের প্রান্ত সীমায় নামিরাহ মসজিদের অবস্থান। তার চত্বরে দেখা হয় জনা দশেক বাংলাদেশির সঙ্গে। তারা সবাই পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কেউ চার মাস, কেউ আট মাস বেতন পাচ্ছেন না। বেতন চাইলে কফিল বলে, চলে যাও। যে এজেন্সির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন তারাও আর দায়িত্ব নিচ্ছে না। 

মো. সুমনের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তগাছায়। বছর দেড়েক আগে সৌদি আরব এসেছেন। তিনি বেতন পান না সাত মাস। ‘রেজা হাইজিন’ নামের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়োগকারী। যখন যেখানে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানটি তাদের পাঠায়। কিন্তু বেতন দেয় না। 

গান্ধর চকলেট কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন শরীয়তপুরের মুছা আ. জলিল ছৈয়াল। তিনি জানান, সৌদি আরবে বিদেশি কর্মীদের জন্য কফিলই সব। কফিল পুলিশে অভিযোগ করলে, সেই কর্মীর সৌদিতে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। এই সুযোগ নিয়ে কর্মীদের লুটছে কফিলরা। মাসে মাসে টাকা আদায় করছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫