Logo
×

Follow Us

আফ্রিকা

ইথিওপিয়ায় হঠাৎ যুদ্ধবিরতির কারণ কী?

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২১ মে ২০২২, ১৫:৪৮

ইথিওপিয়ায় হঠাৎ যুদ্ধবিরতির কারণ কী?

যুদ্ধবিরতি কোনো শান্তি চুক্তি নয়। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক এক মাস পর ২৪ মার্চ ইথিওপিয়ার সরকার দেশটার উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলের নেতৃত্বের সাথে চলা ১৭ মাসের গৃহযুদ্ধ হঠাৎ করেই একতরফাভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিরতি ঘোষণা করে।

এ বিষয়ে সরকার বলে যে, এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পাঠানোর একটা সুযোগ করে দেবে। এর চার দিন পর তিগ্রে অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘টিপিএলএফ’ এটিকে স্বাগত জানিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পক্ষে বিবৃতি দেয়। একইসাথে তারা বলেছে, তারা শান্তি চুক্তির বিষয়ে আশাবাদী। ২৫ এপ্রিল তিগ্রে বিদ্রোহীরা আফার অঞ্চল থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়; যা কি-না ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য শর্ত হিসেবে দেখছিল। 

৫ মে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফানে দুজাররিক সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে চার দফায় সড়কপথে ১৬৯টি ট্রাকে করে মোট ৪ হাজার ৩০০ টন দ্রব্য সেখানে পরিবহন করা সম্ভব হয়েছে। তথাপি এই ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আর বিশেষ করে ইথিওপিয়া সরকার তিগ্রে অঞ্চলে বিদ্যুৎ, টেলিকম এবং ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দেওয়ায়, সেখানে যে কোনো কিছু করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ডব্লিউএফপি’র হিসেবে তিগ্রে অঞ্চলে দিনে ১০০ ট্রাক মালামাল নেওয়া প্রয়োজন; আর পরিবহন চালিয়ে নেওয়ার জন্য সপ্তাহে ২ লাখ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন। জানুয়ারি থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত আকাশপথে তিগ্রে অঞ্চলে মোট ৪২৮ টন খাদ্য পাঠানো গেছে; যা কি-না মাত্র ১১ ট্রাকের সমপরিমাণ! অনেকেই বলছেন যে, তিগ্রে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে ড্রোন।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কেউ স্বীকার না করলেও ইথিওপিয়া সরকারকে তুরস্ক, ইরান, চীন এবং সম্ভবত আরব আমিরাত মনুষ্যবিহীন ড্রোন সরবরাহ করেছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’র এক বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জুনে তিগ্রেরা সরকারি বাহিনীকে তাদের অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। এরপর তারা তিগ্রে অঞ্চল থেকে বের হয়ে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার মাত্র ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। তবে সরকারি বাহিনী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ড্রোন ব্যবহার শুরুর পর থেকে তিগ্রে বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হন। অপরদিকে তিগ্রে অঞ্চলের পক্ষে শক্তিশালী কোন দেশ অবস্থান না নেওয়ায় এবং তিগ্রেদের সাথে যোগ দেওয়া অরোমো অঞ্চলের গেরিলারা খুব একটা শক্তিশালী ভূমিকা না রাখতে পারায় তিগ্রেদের জয়লাভের আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার সরকার ঘোষণা দেয়, সরকারি বাহিনী তিগ্রে অঞ্চলের ভেতরে আর ঢুকবে না। 

‘আইসিজি’- এর মতে, ইথিওপিয়ার অর্থনীতি হয়তো যুদ্ধবিরতির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই দেশটার মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে খরা, ঋণ পরিশোধ করতে না পারা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আইএমএফের চাপ প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

অপরদিকে তিগ্রেরা চাইছে তাদের অঞ্চলের পশ্চিমাংশ ফেরত পেতে, যা কি-না যুদ্ধের শুরুতেই পার্শ্ববর্তী দেশ এরিত্রিয়ার সহায়তায় আমহারা অঞ্চলের মিলিশিয়ারা দখল করে নেয় এবং ৭ লাখ তিগ্রেকে জোরপূর্বক ঘরছাড়া করে। ফলে তিগ্রেরা তাদের প্রতি সদাচরণ করা সুদানের সীমানার সাথেযোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে সীমান্ত শহর হুমেরা দখল করে রাখার মাধ্যমে এরিত্রিয়া, আমহারা তিগ্রে অঞ্চলকে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং যে কোনো ত্রাণের জন্য তিগ্রেকে ইথিওপিয়া সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল করে। এখন ইথিওপিয়া সরকার সেই ত্রাণের বিনিময়ে তিগ্রেদের কাছ থেকে অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চাইছে। তিগ্রের পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব খুব সহজেই চলে যাচ্ছে না। সরকারের শর্তের বেড়াজালে পড়ে তিগ্রেরা যদি সামনের দিনগুলোতে সুদানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে চায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।  

ইথিওপিয়া সরকারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একমাস পর এবং তিগ্রে বাহিনীর আফার অঞ্চল ত্যাগ করার চার দিন পর ২৯ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদের সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইথিওপিয়া সরকারের অনেকগুলো পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধ শেষ হবার একটা আশা তৈরি হয়েছে; যেগুলির মাঝে রয়েছে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া, কিছু রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া এবং একটা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা। একইসাথে তিনি তিগ্রেদের প্রশংসা করেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য এবং আফার অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। সর্বশেষে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটা একত্রিত সার্বভৌম ইথিওপিয়া চায়, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে করে দেশটার বিভাজনগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। 

যুদ্ধবিরতি পুরোপুরিভাবে কার্যকর করাটা যে খুব একটা সহজ নয়, তার প্রমাণ মিলে খুব দ্রুতই। ব্লিনকেনের বিবৃতির দিনই ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমহারা অঞ্চলে অরোমিয়ার সাথে সীমান্তে কিছু সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেওয়া রাবিত শহরে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। তবে এতে কোন গ্রুপ জড়িত ছিল, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কারণ একপক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করছে। 

পশ্চিমা দেশগুলো যখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইথিওপিয়ার সরকারের ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতি অনেকেই পছন্দ করছে। অন্তত মার্কিন সরকারের কাছে ইথিওপিয়া সরকারের পক্ষ নেওয়াটা অনেক সহজ হয়েছে, যেখানে ওয়াশিংটনের পছন্দের নোবেল বিজয়ী আবি আহমেদের সরকারের ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবরগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াদায়ক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ড্রোন ব্যবহারে ইথিওপিয়া সরকার যখন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চাপই ইথিওপিয়ার সরকারকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

তবে বলাই বাহুল্য যে, যুদ্ধবিরতি কোনো শান্তি চুক্তি নয়; অস্থির আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির একটা প্রতিফলন মাত্র। দেশটার জাতিগত বিরোধ যুদ্ধের মধ্যে দগদগে ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে, যা মুছে ফেলা কঠিন। এই বিভেদগুলোই পূর্ব আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন’ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জ্বালানি হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫