
টের শব্দটি বাংলা ভাষার অদ্ভুত সুন্দর একটি শব্দ। অনেকটা আলগোছে বুঝে নেওয়ার মতো হলেও টেরের মধ্যে বোঝাবুঝির নাতিদীর্ঘ প্রক্রিয়াটি নেই, হঠাৎ পাতা নড়ার মতো, জলে একটা ডুব্ হওয়ার মতো ‘টের’ পাওয়া হয়ে যায়। টের যে পায় সে পায়, তার সময় লাগে না পেতে। এটা কীভাবে ঘটে তা প্রায় সংস্কৃতিতে কিছুটা দুর্বোধ্য। যে গুণে মানুষ টের পায় সেই ক্ষমতাই কবিতা।
হৃদয় খুঁড়ে জেগে ওঠা ঘুম ভাষাহীন। কবিতা একরকম জেগে থাকা। চৈতন্যের শিখা দপদপ করতে থাকার মতো। স্বপ্ন স্বপ্ন আরেক ধরনের জাগরণ। কবিতার মধ্যে যেমন ভাষা জেগে ওঠে, হৃৎকলসের জল টলে ওঠে, স্বপ্ন হলো ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠা। চেতনার নদীতে অন্ধকার চরের বুক জাগে। একটা অচেতন বাদাবন; সেখানে বাস্তবতায় আধডোবা মানুষেরা ঊর্ধ্বচারী শেকড় দিয়ে শ্বাস নিই-আমাদের মন সেই শেকড়।
কবিতা তাই ভাষার এক মায়াবী ইন্দ্রীয়।
দুনিয়া বাস্তব নামক চরম অবাস্তব এক যুক্তিতে চলে। স্বপ্ন আর কবিতা চলে কল্পনায়। কল্পনা ছাড়া অর্থ, বোধ, জানা, ব্যাখ্যা, ধর্ম হয় না। মানুষকে এত দেখি কিন্তু পুরোটা বুঝতে গেলে কল্পনা করে নিতে হয়, কোনো মহাপুরুষের ছবিতে মহামানুষবোধ স্থির হতে পারে না-তাকেও কল্পনা করে নিতে হয়।
কল্পনার এই নিরাকারকে একেক কবি একেক ভাষায় ধরতে চেয়েছেন। লালন তার নাম দিয়েছিলেন অচিন পাখি। সেই অচিন পাখিটা বহুকাল হলো উড়ছে বাংলা কবিতায়। বলাকা হয়ে, সারস হয়ে, সন্ধ্যাহাঁস হয়ে তারা উড়েছে। একে কী বলা যাবে?
লালনের সেই অচিন পাখিটারই খোঁজ চলেছে কবিতায়। কখনো তারা বলাকা, কখনো মূল সারস কিংবা প্রকৃত সারসের রূপে দেখা দিয়েছে। আবার হারিয়েও গেছে।
রবীন্দ্রনাথের
‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে।’
জীবনানন্দ দাশের
‘সন্ধ্যার নদীর জলে একভিড় হাঁস অই-একা;
এখানে পেল না কিছু; করুণ পাখায়
তাই তারা চলে যায় শাদা, নিঃসহায়
মূল সারসের সাথে হলো মুখ দেখা।
বিনয়ের, ‘মানুষ নিকটে গেলে
প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’
সন্ধ্যার আকাশে এই তিন পাখির উড়াল একইরকম দেখায় মানুষের চোখে। বলাকা, মূল সারস আর প্রকৃত সারস এক জাতীয় হলেও, তিনের চলন ভিন্ন। বলাকা উত্তীর্ণ হতে চায় পরম কোনো আকাশে, সুদূরে-বলাকা ট্রান্সেডেন্টাল; ইহজগতের নয় যেন সে। প্রকৃত সারসও তাই, মানুষ নিকটে গেলে সে উড়ে যায় প্লেটোনিক শুদ্ধতার আকাশে। মানুষ তাকে ছুঁতে পারে না।
এ দিক থেকে বিনয় বরং রাবীন্দ্রিক-যদিও তার কবিতার ভাষা জীবনানন্দের চাইতে আলাদা না। কিন্তু জীবনানন্দের পাখি বলাকা বা প্রকৃত সারসের মতো অধরা না। সেই পাখি আশ্রয় দেয় সন্ধ্যার নদীর জলে করুণ পাখার একাকী হাঁসগুলোকে। এই সারস ট্রান্সেন্ডেন্স চায় না, চায় এমানেন্স-লগ্ন হতে লিপ্ত থাকতে। ইন্দ্রীয়াতীত জগতের বলাকা ও সারস আসলে পরমেশ্বরবাদী।
আর জীবনানন্দের হংস ও সারস সর্বেশ্বরবাদের প্রতীক। একটা স্বর্গীয় আরেকটা জাগতিক। রবীন্দ্রনাথের নিরাকার ঈশ্বরবাদের সঙ্গে এখানে গণিতবিদ বিনয়ের মহাজাগতিক বোধ মিলে যায়। কিন্তু জীবনানন্দ থেকে যান কৃষক জগতের গ্রামীণ মায়ায়, সব কিছুর প্রতি ভালোবাসায়। তার এই পাখির তালাশ ‘কল্পনাবিলাস নয়, কিন্তু কল্পনা-মনীষার সাহায্যে যেন কোনো মহান- কোনো আদিম জননীর নিকট- কোনো অদিতির নিকট প্রশ্ন, বারংবার প্রশ্নের বেদনা, প্রশ্নের তুচ্ছতা’ (কবিতার কথা)।
সেই মূল সারসের মুখ তিনি দেখেন বনলতার মুখে। তাকে হয়তো একবার পাওয়া যায়- পায়নাকো আর; তবু তো দেখা হয়। পাওয়া যায় না রবীন্দ্রনাথ আর বিনয়ের পাখিকে। কিন্তু আমাকে বিস্ময়াবিভূত করে রাখে অন্য এক পাখি। যার নাম নেই, গান নেই, ছায়া নেই, কায়া নেই। কিন্তু সে আছে। আমার আপন খাঁচার ভেতর তার কখনো ব্যাপক ঝাপটানি কখনো তিরতির আসা-যাওয়া দিয়ে টের পাই সে আছে। ভালো করে দেখলে বুঝি, বাংলা কবিতার ভাবগুরু লালন সাঁইয়ের অচিন পাখিকেই বুঝি ধরতে চেয়েছিলেন আধুনিক তিন কবি- তিনের মতো করে। তবু অচিন পাখির রহস্যপাখার ঝাপটানি মনের মধ্যে রয়েই যায়, তাকে ধরা যায় না।
কবিতার ভাষা দিয়ে সেই অধরচাঁদকে ধরা না গেলেও টের পাওয়া যায়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক