
সুকুমার বড়ুয়া। ছবি: সংগৃহীত
সাহিত্য সুন্দরেরই বহিঃপ্রকাশ। সেই সুন্দর একেক সময় একেক স্তর বা মাত্রায় প্রকাশিত হয়। একসময় ছড়া ছিল শুধু শিশুদের মনোরঞ্জনের বিষয়। দাদি-নানির মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। এরপর পেল লিখিত রূপ। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হলো ছড়া- ভাষায়, উপস্থাপনায় ও প্রকাশভঙ্গিতে। বিষয়ে বৈচিত্র্য এলেও আঙ্গিকগত পরিবর্তন এলো অতি ধীরে।
যা-ই হোক, ছড়া এখন বিভিন্নমুখী- শিশুতোষের পাশাপাশি গণমুখীও। সমাজ বাস্তবতার নিরিখে ছড়া এখন খাপখোলা তলোয়ার; বক্তব্য স্পষ্ট, একেবারে ঘোর-প্যাঁচহীন। অর্থোদ্ধারে পাঠককে ভাবনার অতলে ডুবে যেতে হয় না। ছন্দের ঝঙ্কারে একবার পড়ার পরই মনে গেঁথে যায়। সত্য নিরূপণে মনোযোগী হন পাঠক। জনমত গঠনেও ভ‚মিকা রাখে উৎকৃষ্ট ছড়া।
সমাজ বিনির্মাণে সমকালীন ছড়ার ভূমিকা তাই অস্বীকার করার উপায় নেই। উপায় যে নেই, তা বহু আগেই প্রমাণ হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আগে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং এরপর থেকে যে কোনো শোষকের অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছড়া দিয়েই কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করা হয়েছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছে শোষকের ভিত।
বাংলা শিশুসাহিত্যের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সুকুমার বড়ুয়া নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন জীবনঘনিষ্ঠতায়। জীবনের চড়াই-উতরাই তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য বলে সমালোচকরা মনে করেন। সেই বিবেচনায় তাকে এককভাবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে মনে করা যায় কিনা- এমন প্রশ্নও কেউ করতে পারেন।
আবার যে মুহূর্তে তার লেখাগুলো অসাধারণ শিশুতোষ ছড়া হিসেবে পাঠকের সামনে হাজির হয় এবং পাঠককে আপ্লুত করে, তখন কিন্তু তাকে শিশুসাহিত্যিক ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। বাংলা ছড়াসাহিত্যের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে যদি কারও নাম করতে হয়, তাহলে সর্বাধিক সমর্থন পাবেন সুকুমার বড়ুয়া। তার সৃষ্টি বিবেচনা করে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাকে একজন সমাজ-সচেতন ও শিশুতোষ ছড়াকার- এ দুভাগে ফেলতে পারি।
সমাজ সচেতনতামূলক ছড়াগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, সেখানেও তিনি ছড়ার স্বাভাবিক ধারা অর্থাৎ সহজ শব্দ ব্যবহারের প্রতি অতিসচেতন। আবার সেগুলো যাতে শিশুদের পাঠ্য হয়, সেদিকেও তার কঠোর দৃষ্টি।
‘ভেজাল’ শিরোনামের ছড়ার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন- ‘খাদ্যে ভেজাল পথ্যে ভেজাল/ভেজাল শখের জিনিসে/চলছে ভেজাল দিল্লি-ঢাকা/বিলেত-জাপান-ভিনিসে।/ভেজাল কত রইল মিশে/মানুষজনের চরিত্রে,/অমনি শাদা অমনি কালো,/অমনি কেন হরিৎ-রে?/হিংসাতেও ভেজাল থাকে/নইলে আবার মিলে যে,/স্নেহের ভেজাল ধরতে পারি/কানমলা-চড় কিলে যে...’
সমাজসচেতন ছড়া হিসেবে তার আরেকটি বিখ্যাত ছড়ার কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি। ‘দেশের গান’ শিরোনামে ছড়াটিতে তিনি বলছেন- ‘সব দেশে যা করতে পারে/আমরা কেন পারব না? এখন থেকে শপথ নেব/ভিনদেশি ধার ধারব না।’
ছড়ায় অনুসৃত উপাদানই বলে দেয় লিখিয়ের মাথায় এই মুহূর্তে সরল জীবন প্রতিফলিত হচ্ছে। কখনো রহস্যঘেরা কিছু, কখনো হাস্যরস কিংবা কখনো একেবারেই ছেলে ভোলানো রূপক দেখা যাবে সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ায়। হাস্যরসের ছড়াগুলো আবার তাকে শিশুসহ সব শ্রেণির পাঠককেই আনন্দ দেয়। সে ক্ষেত্রেও সুকুমার বড়ুয়াকে মনে হতে পারে তিনি সর্বমহলেরই ছড়াকার।
এর অন্যতম প্রধান কারণ, তার ছড়ার রসবোধ। পাঠক যখন শিশু হয়, তখন সে মনে করে সুকুমার বড়ুয়া তার জন্যই লিখেছেন, আবার সেই শিশুর মা-বাবা যদি পড়েন, তখন তিনিও মনে করেন- ছড়াটি তাদের জন্যই লেখা হয়েছে। এই মুন্সিয়ানা তাকে অনন্য করে তুলেছে।
কিছু ছড়ায় হাস্যরসের নমুনা স্পষ্ট হলেও সেখানে তিনি সমাজের চেহারাও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এমনি একটি বিখ্যাত ছড়ার নাম ‘ঠিক আছে’- ‘অসময়ের মেহমান/ঘরে ঢুকে বসে যান/বোঝালাম ঝামেলার/যতগুলো দিক আছে/তিনি হেসে বললেন;/ঠিক আছে। ঠিক আছে।/রেশনের পচা চাল/টলটলে বাসি ডাল/ থালাটাও ভাঙাচোরা/বাটিটাও লিক আছে/খেতে বসে জানালেন/ঠিক আছে। ঠিক আছে।...
গ্রামে জন্ম বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন সুকুমার বড়ুয়া। অন্তত গ্রামভিত্তিক ছড়াগুলো পাঠ করে সহজেই এমন মন্তব্য করা যায় তার সম্পর্কে। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি নগর নিয়ে ছড়া লেখেন, তখন আবার তিনি যে নগরেরই মানুষ- তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। ছড়ায় রস ছড়িয়ে দেওয়া এমনি একটি ছড়া ‘ঢাকাযাত্রা’- ‘হাঁস যায় বাঁশ যায়/ছাগলের ঘাস যায়/গলাকাটা লাশ যায়/শাক মাছ আলু কচু/ফল যায় পাকা-/ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা...’ এমন অনেক বিষয় নিয়েই সাবলীলভাবে তিনি ছড়া লিখেছেন। আঙ্গিকগতভাবে তাতে যেমন নতুনত্ব রয়েছে, তেমনি বিষয়ের ক্ষেত্রেও।
সব বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখা প্রকৃত লেখকের বৈশিষ্ট্য। কালে অবস্থান করে মহাকালের কথা বলার অপরিসীম ক্ষমতা তো লেখকেরই থাকে। সুকুমার বড়ুয়া যে প্রকৃত লেখক, তার প্রমাণও রেখেছেন ‘বুদ্ধি’ ছড়ায়- ‘ছোট ছোট বানরের/বড় বড় পেট/বাদাবনে বসিয়েছে/ইন্টারনেট-/কোন দেশে কোন মাসে/কী কী ফল পায়/ফ্যাক্সের মাধ্যমে/সব জানা যায়।’ অর্থাৎ প্রযুক্তির উৎকর্ষে সবকিছু যে হাতের নাগালে একসময় চলে আসবে, তা তিনি অনেক আগেই বলে দিয়েছেন।
সুকুমার বড়ুয়ার ব্যক্তিগত জীবন বিস্ময়ে ভরা। গত শতাব্দীর ’৫০-এর মন্বন্তরকালে বাবার নিরুদ্দেশ যাত্রার পরম জীবনের যে এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন ভালোভাবেই। তার সৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনেই তা স্পষ্ট হয়। দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন মানুষকে কীভাবে সংগ্রামী হতে হয়, লড়াই করে টিকে থাকতে হয় এবং তা ভালোভাবেই, তার জীবনপাঠ করলে সে মন্ত্র আমরা পাই।
এই সংগ্রামমুখর জীবনের ফাঁকে তিনি অসংখ্য সৃষ্টিতে ভরপুর করে দিয়েছেন বাংলা শিশুসাহিত্য তথা ছড়াসাহিত্যভূমি। স্বল্পশিক্ষিত এ সৃষ্টিশীল মানুষকে বিস্ময়কর ছড়াকার হিসেবে আখ্যায়িত করতে গিয়ে আবারও বলতে হয়, ঈশ্বরের অপার দান তার ওপর বর্ষিত হয়েছে। তিনিও সেই দানের যথাযথ ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিয়েছেন পাঠকের মধ্যে; অনেকটা কালজয়ী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো। নিশ্চয় তার রচনা আগামীর পাঠকের কাছে আরও গ্রহণীয় হবে এবং কালে কালে তা চর্চিত হবে- এ প্রত্যাশা করাই যায়।
সুকুমার বড়ুয়ার জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে। অল্প বয়সেই তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন সময় তিনি মেসে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ফলমূল, আইসক্রিম, বুট বাদাম ইত্যাদি ফেরি করেও বিক্রি করেছেন। ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চৌষট্টি টাকা বেতনের চাকরি হয় তার।
১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর কিপার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত এ ছড়াকার সৃষ্টিশীল জীবনে অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ও পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কবির চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক অন্যতম।