
প্রতীকী ছবি।
বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ- এই তিনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ শব্দ ভাষা। এই ভাষার কারণে, আমরা জাতিগতভাবে আলাদা সত্তার অধিকারী। এই ভাষা আমাদেরকে বিশেষভাবে দান করেছে আলাদা সম্মান। কারণ একমাত্র আমরাই পৃথিবীর বুকে উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি- ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণদানেও দ্বিধা করিনি আমরা।
কিন্তু হায়, হুজুকে বাঙালি! কালের বিবর্তনে সেই ভাষার আজকে বেহাল দশা। যে ভাষাতে গান কবিতা রচনা করে রবীন্দ্রনাথ এনেছে নোবেল, সেই ভাষার আজ কোনো নেই শ্রী-ছাদ। আধুনিকতার নামে নাটক, গান, গল্প, সিনেমায় যে বাংলা শুনি আদতেও কি তা প্রমিত বাংলা? কিংবা সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোত্তম মাধ্যম ফেসবুকে বাংলার যে ব্যবহার দেখি, সত্যি কি এই ভাষা সেই ভাষা! যার জন্য আমার ভাইয়েরা প্রাণ দিয়েছিলো।
না এই বাংলা সেই বাংলা, বা সেই বাংলা এই বাংলা নয়। অতি অল্পসময়ে খ্যাতি আসায় বর্তমানে শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে যে বাংলার চল চলছে তা আমাদের সেই মিষ্টি বাংলা ভাষা না। আঞ্চলিকতা সাহিত্যে আসতেই পারে, কিন্তু তারও একটা নিয়ম থাকতে হয়, যে বাংলা আজ চর্চিত হয়ে চলেছে চতুর্দিকে তা বহুলাংশে বর্জিত প্রমিত বাংলা থেকে। বলতে পারেন আমি কে, আবার কেউ না, আবার সব-ই। এই ভাষা আমার মায়ের ভাষা, আমি আজ এই ভাষায় কথা বলছি, ভবিষ্যতে আমার উত্তরসূরিরা কথা বলবে এই ভাষায়, তাই বাংলার সঠিক রূপ- উচ্চারণ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।
বাঙালি হয়ে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাই। লজ্জা পাই বাংলায় লিখতে ও পড়তে। একটু টাকা পয়সা হলে স্বপ্ন দেখি সন্তানকে ইংরেজি ভাষা পড়াতে। বাংলা মাধ্যমে পড়ালে কি আর ইংরেজি উচ্চওয়ালাদের চাকর হওয়া যাবে! এখানে আপনি রাগ দেখাতে পারেন, চাকর হবো কেন? আরে চাকরি যে করবে সেই তো চাকর! ইংরেজরা ২০০ বছর শোষণ করে যে স্বাধীনতা দিয়ে গেলো, সাদা চামড়ার আভিজাত্য চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে গোপনে- আমাদের অবচেতনে মনে এবং চিন্তায়।
তাই কম্পিউটারে, মোবাইলে বাংলা লেখার সুবিধা থাকলেও ইংরেজি অক্ষর দিয়ে ভুল-ভাল বাংলা লেখার মোহ আজও আমরা ছাড়তে পারি না। আসলে আমরা ছাড়তে চাই না। আমি অনেককেই জিজ্ঞেস করি, কেন লিখেন না বাংলায়? তখন সোজাসাপ্টা জবাব বাংলায় লেখা অনেক কষ্টের। কেবল এই নয়, আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমার বোনের ছেলে-মেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র সব কিছুতেই তাদের আগ্রহ অসীম, কেবল বাংলা পড়া ছাড়া। তাদের বাংলা লিখতে ও পড়তে খুবই কষ্ট।
শুধু যে আমার আপন জনদের অবস্থা এমন তা নয়। অফিসের কলিগ, বন্ধুদের সন্তান সবারই একই অবস্থা। আমার কেবল একটাই প্রশ্ন কেন?
এত মিষ্টি একটা ভাষা, এতো সমৃদ্ধ একটা ভাষা, যে ভাষাতেই কেবল আছে- আমি, তুমি, তুই; যা দিয়ে কে কাছের কে দূরের, কে পরিচিত কে সম্মানিত- সবই প্রকাশ করা সম্ভব। সেই ভাষার বেহাল দশার দায়ভার কি সত্যি আমাদের নয়? আমি বাঙালি বলে যেমন গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে, তেমনই বাংলায় লিখতে পড়তে ও বলতে মন ভরে ওঠে। যে ভাষা পৃথিবীর বুকে আমাদের দান করেছে আলাদা এক মাত্রা, সে ভাষায় শুদ্ধ করে বলতে না পারাটা আমার কাছে লজ্জার। ইংরেজি বলতে না পারাটা নয়, সেই ভাষা শুদ্ধ করে লিখতে না পারাটা আমার কাছে কষ্টের ইংরেজি না পারাটা নয়।
লেখক : অনুবাদক ও সাহিত্য সমালোচক