ছোট কাগজ, তারুণ্যের নতুনত্ব
রক্ত নদী পেরোনোর গল্প

জিভান রিজভি
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৪০

ছবি: সংগৃহীত।
ছোট কাগজ হলো লেখকদের আঁতুড়ঘর। বলা হয়, ছোটকাগজে লিখতে লিখতে নবীন লেখক একদিন পরিণত লেখক হয়ে ওঠেন। ছোট কাগজে তরুণ লেখকদের নিরীক্ষার মাধ্যম। এখানে তরুণ লেখকদের নতুন চিন্তার প্রকাশ পাবে, প্রচল ও প্রথা ভাঙার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যাবে, এইটাই ছিল অভিপ্রেত।
ছোট কাগজে লিখবে নতুন লিখিয়েরা হাত খুলে, এটাই ছিল মূল লক্ষ্য। অথচ তা হয়নি, নিশ্চিত হয়নি নতুনের লেখা প্রকাশের এই ছোট কাগজগুলো। একালে ছোট কাগজ তার পূর্বেকার ধ্যান-ধারণা বদলে তৈরি করে নিয়েছে- নতুন পথ, নতুন মত ও নতুনত্বহীনতাও। হয়ে উঠেছে গুটিকয় পরিচিত লেখকদের ঘুরেফিরে লেখা ছাপাবার জায়গা।
দেখা গিয়েছে যে একই লোকের বৃত্ত থেকে পাঁচটা পত্রিকা বেরোয়, এবং পাঁচ পত্রিকার পাঁচ সম্পাদক। কোনো পত্রিকার একটা সংখ্যা বেরোনোর ছয় মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সম্পাদক পরের সংখ্যা বের করতে প্রস্তুত, কিন্তু নানান ইন্টেলেকচ্যুয়্যাল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পর অহেতুক তত্ত্ব কপচিয়ে সেই বৃত্তপ্রধান কবিপনা, পত্রিকাপ্রাণ তারুণ্য-তৎপর সম্পাদকের উৎসাহের রাশ টেনে রাখেন গ্রুপবাজ লেখক ও সম্পাদক দল। ফলে মুখথুবড়ে পড়ে আমাদের ছোট কাগজ চিন্তা, লেখা ও তারুণ্য।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে তারা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রকাশ করতে তৎপর হন। ফলে, ছোট কাগজ আদতে আর ছোট কাগজ নেই। হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের আখড়া। তবুও কিছু কাগজ এখন অবধি তাদের গোষ্ঠী গোঁড়ামী বজায় রেখেছে, রক্ত নদীর স্রোত বেয়ে একদা যে ছোট কাগজ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এদেশে তার সেই সুনাম এখন ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। অচলায়নকালে তাই প্রকৃতঅর্থে ছোট কাগজ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
এদেশে সাহিত্যচর্চার এক সময়ের যে প্রধান ক্ষেত্র ছিল ছোট কাগজ তা বিলুপ্তপ্রায়। এর বাইরে সাহিত্যচর্চার আরেকটি ক্ষেত্র হলো সাহিত্য পত্রিকা। ছোট কাগজের সঙ্গে সাহিত্য পত্রিকার বিষয়বস্তুভিত্তিক এবং গঠনগত পার্থক্য আছে। ছোট কাগজের যেমন বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই একেবারে, যা রয়েছে তা প্রকৃত সাহিত্যচর্চা।
আবার সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক রয়েছে চূড়ান্তভাবে। ছোট কাগজ একেবারে গ্রাম পর্যায় থেকে দেশের সব মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাহিত্য পত্রিকাগুলো প্রকাশ পায় দেশের রাজধানীকেন্দ্রিক। ছোট কাগজের মূল কমিটমেন্টও থাকে আঞ্চলিক পর্যায়ে লেখক তৈরিতে। মফস্বল থেকে এবং ব্যক্তি প্রচেষ্টায় বের হয় বলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী, প্রথাবিরোধী ও নিরীক্ষাধর্মী মেজাজ এর সহজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। শিল্পচর্চার পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক কমিটমেন্ট এখানে মুখ্য থাকে।
বাংলাসাহিত্যে ছোট কাগজ এবং সাহিত্য পত্রিকার উৎসমূল অভিন্ন। যেমন- প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪), কল্লোল গোষ্ঠীর ‘কল্লোল’ (১৯২৩), নজরুলের ‘ধূমকেতু’, বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমারের ‘প্রগতি’ (১৯২৭), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ (১৯৩১), বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ (১৯৩৫), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯৩৮) এগুলো থেকেই ছোট কাগজ ও সাহিত্যবিষয়ক এই দুই ধরনের পত্রিকার জন্ম হয়েছে।
এদেশে ৬০-এর দশকে সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর ও কণ্ঠস্বর সম্পাদক- আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, পত্রিকা দুটি বেশ সাড়া ফেলেছিলো, এই দুই কাগজ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল অনেক শক্তিমান লেখকের। এরপর আশির দশকে ছোট কাগজ ‘গান্ডিব’ সম্পাদক তপন বড়–য়া-এর মাধ্যমে বাংলা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লেখা শুরু হতে থাকে ইশতেহার দিয়ে। এ সময়ের আরও কিছু কাগজ আসলেও গান্ডিবই ছিলো প্রধান কাগজ তা নির্বিঘ্নে বলা চলে।
এই কাগজের মাধ্যমে তৈরি হয় বেশ কিছু নতুন লেখক ও কবি। সময় বদলেছে, গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজ দু-একটি সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পর বন্ধ হয়েছে। তবুও আশা রয়ে গেছে, সময়ের তারুণ্যদীপ্ত নতুন সম্পাদকরাও থেমে নেই। প্রকাশ করছেন নিজেদের নতুন ভাবনার লেখা নিয়ে ছোট কাগজের নামে এক ধরনের সাহিত্য পত্রিকা কিংবা মিডি ম্যাগ, ফ্যাট ম্যাগ যা-ই বলি। এর মধ্যেই তারা প্রতিবাদ করার চিন্তা করছেন প্রথাগত সাহিত্য রচনার। বাঁধা, বিপত্তি পেরিয়ে ফের উঠে দাঁড়ায় ছোট কাগজ, যেন রক্ত নদী পেরোনোর সে গল্প।