আর্থার সি ক্লার্ক: কল্পবিজ্ঞানে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ

মিরন মহিউদ্দীন
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:২৭

আর্থার সি ক্লার্ক। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
ঘণ্টি বাজিয়ে ছোট্ট ছেলেটা চলেছে সাইকেলে চড়ে বাড়ি বাড়ি কাগজ দিতে। কিন্তু কাগজ বিলিতে মোটেও তার মন নেই। মাথার ওপর সূর্য তারা চাঁদকে সঙ্গী করে যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড, তারই সুলুক সন্ধান পেতে চায় সে। তাই কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করে ফেলেছে একটা পুরনো টেলিস্কোপ আর তার সাইকেলের সামনের স্ট্যান্ডে বসিয়েছে সেটা। তারায় ভরা আকাশটাকে আরও ভালো করে চিনবার জন্য।
আর শুধু চেনাই নয়, চাঁদের মানচিত্রও বানিয়ে ফেলেছে। শুধু দেখা বা আঁকাই নয়, জুনিয়র অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে লিখেও ফেলেছে মহাকাশ যান আর মহাকাশ যাত্রা নিয়ে প্রবন্ধ। স্কুলের পত্রিকাতেও লিখেছে। রকেট বানিয়ে পরীক্ষাও করেছে ১৩ বছর বয়সে।
এর বছর দুয়েক বাদে ব্রিটিশ ইন্টার প্লানেটরি সোসাইটির সদস্য হন তিনি। বছর ১৭ যখন বয়স তখন আলোর সাহায্যে শব্দ তরঙ্গ পাঠানো নিয়ে গবেষণা করেছেন। এভাবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দূরদর্শী কল্পবিজ্ঞান লেখক হয়ে ওঠার সলতে পাকানো শুরু হয় আর্থার চার্লস ক্লার্কের।
১৯১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের সমারসেটের ছোট্ট প্রাচীন বন্দর শহর মাইনহেডে জন্ম আর্থারের। দুই ভাই ফ্রেডারিখ উইলিয়াম, মাইকেল আর বোন মেরি-চার ভাইবোনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ সে। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্নালু চোখে ছিল কল্পবিজ্ঞান নিয়ে অসম্ভব এক কৌতূহল। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের যাত্রার প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ। পরবর্তীকালে তার লেখার মধ্য দিয়ে সেই বিহ্বলতা বারংবার যে ফুটে উঠেছে তাই নয়, বিশ্ব তার এই ভালোবাসার ফলিত রূপ আজ স্বচক্ষে দেখতে শুরু করেছে।
এদিকে ঠিক এই সময়ে অতলান্তিকের ওপারে মার্কিন মুলুকে এমন একটি ব্যাপার ঘটছে যা কিশোর আর্থারের মনোজগৎকে এক ঝটকায় মহাবিশ্বের আনাচেকানাচে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াবে, অজানা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ এনে দেবে। ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে গার্নসব্যাক হুগো আনলেন বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা অ্যামেজিং স্টোরিজ। দুপুরের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে পত্রিকার ১৯২৮ সালের নভেম্বর সংখ্যাটা জোগাড় করল বছর এগারোর আর্থার। এক নয়া দিগন্ত খুলে গেল এই কল্পনাপ্রবণ কিশোরের সামনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে শুরু করল কল্পবিজ্ঞান পত্রিকার পাতায়।
এখানে গার্নসব্যাক হুগোর একটু পরিচয় দেওয়া যাক। হুগোকে এইচ জি ওয়েলস আর জুলে ভার্নের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে কল্পবিজ্ঞানের জনক মনে করা হয়। সেটা অবশ্য যতটা না তার কাহিনির জন্য, তার চেয়ে ঢের তার কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা অ্যামেজিং স্টোরিজের জন্য। অবশ্য লেখকদের প্রাপ্য অর্থ না দেওয়ার অভিযোগ হুগোর নামে বারংবার উঠেছে। এই সব বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে বিশ্ব অবশ্য হুগোকে মূলত মনে রেখেছে প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকার প্রাণপুরুষ হিসেবেই।
তার নামানুসারে প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন কনভেনশনে আগের বছরের কমপক্ষে ৪০ হাজার শব্দের সেরা কল্পবিজ্ঞান কাহিনিকে হুগো পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে ফল অব মুনডাস্ট, ১৯৭৩ সালে রঁদেভু উইথ রামা, ১৯৭৯ সালে ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইস আর ১৯৮৩ সালে ২০১০ স্পেস ওপিসি টু-এই চারটি বইয়ের জন্য ক্লার্ক সব মিলিয়ে চারবার হুগো পুরস্কারে ভূষিত হন।
এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে রঁদেভু উইথ রামা, ১৯৭৯ সালে ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইস মার্কিন কল্পবিজ্ঞান পুরস্কার নেবুলাও পায়। ১৯৮৭ সাল থেকে অবশ্য ব্রিটেনেই চালু হয়েছে আর্থার সি ক্লার্ক পুরস্কার। আগের বছর ইংল্যান্ডে প্রথম প্রকাশিত সেরা কল্পবিজ্ঞান কাহিনি এই পুরস্কার পায়।
যা-ই হোক আমরা ফিরি আর্থারের ছেলেবেলায়। কল্পবিজ্ঞান পত্রিকার পাশাপাশি দুটো কল্পবিজ্ঞান কাহিনিও প্রবলভাবে আন্দোলিত করল আর্থারের কিশোর মনকে। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক উইলিয়াম ওলাফ স্টেপেলডন মানুষের আগামী দুশ কোটি বছরের ইতিহাসকে নিয়ে লিখলেন। পরের বছর তা হাতে পেল কিশোর আর্থার। সুদূর ভবিষ্যতের এই ঝাঁকি দর্শন তাকে আকৃষ্ট করল। ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ছবি তিনি এঁকেছিলেন তার স্পেস ওডিসি সিরিজের কাহিনিগুলোতে, তার কাঠামো গড়া হয়তো তখন থেকেই তার অবচেতন কল্পনাপ্রবণ মন শুরু করে দিয়েছে।
গার্নসব্যাকের এক সহযোগী ডেভিড লেসার ১৯৩১ সালে রকেটে চাঁদে যাওয়া নিয়ে এক তথ্য সংবলিত গল্প ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব স্পেস’ লিখলেন। মহাকাশ ভ্রমণ যে নিছক কল্পনা নয়, তা যে কঠিন বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনা সম্ভব, তাও দেখালেন লেসার। বলাই বাহুল্য, এই বই ১৯৩২ সালে যখন কিশোর আর্থারের হাতে এলো, তখন তার কিশোরমনে তা গভীর রেখাপাত করল। সারাজীবন যিনি মহাকাশ ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন, তার হাতেখড়ি হলো বলা যায় লেসারের লেখনীতে।
অনেক পরে আর্থার যখন বিশ্বখ্যাত লেখক তখন বলেছিলেন, “ঠিকঠাক করে বলতে হলে বিংশ শতকের গোড়ায় এসব কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা দেখেই ২০ ও ৩০-এর দশকে আমার লিখতে শেখা।” আর পত্রিকাগুলো শুধু পড়েই তো ক্ষান্ত হতেন না আর্থার, কোনো জায়গায় ভুল মনে হলে তা নিয়ে সম্পাদক মশাইকে পত্রাঘাতও করতেন। সম্পাদকও এত মনোযোগী খুদে পাঠক পেয়ে খুশিই হতেন। উৎসাহ দিয়ে বলতেন, তাহলে আরও ভালো লেখা আর্থারই দিক না।
এভাবেই হাসি কান্নায় শৈশব শেষে কৈশোরে পড়ল আর্থার। সংসারের অবস্থা ঠিক এই সময়ে বেসামাল হয়ে পড়ল। ১৯৩১ সালে মারা গেলেন আর্থারের বাবা চার্লস রাইট ক্লার্ক। ১৪ বছরে পড়তে না পড়তেই পিতৃহীন হলেন আর্থার। মা মেরি নোরা উইলিস ছিলেন অশ্বারোহণে পারদর্শিনী। তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলেন ঘোড়া চড়ানো শিখিয়ে যদি সংসারে দু’পয়সা আয় করা যায়।
কিন্তু আয় তেমন হলো না। টানাটানির সংসারে তাই আর্থারের পড়াশোনা টনটনের হুইশ গ্রামার স্কুলের পর থমকে গেল। কলেজে পড়া তখনকার মতো আর হলো না। কাগজ ফেরি করেও তেমন সুবিধা হলো না। অগত্যা পেটের তাগিদে আর্থারকে বেরোতেই হলো বাড়ি থেকে। ১৯৩৬ সালে উনিশ বছরের কিশোর কাজের খোঁজে লন্ডনে পাড়ি জমাল।
তবে এই ছোট্ট পরিসরে এমন কিছু সে ভালোবেসে ফেলল যা তাকে সারাজীবন সঙ্গ দিল। সমারসেটের খামার বাড়িতে জন্ম হলেও আদতে তার ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে সমুদ্রের ধারে, দাদির কাছে। সমুদ্রের সঙ্গে তার আজীবন প্রেমের সেই তো শুরু। লন্ডন মস্ত শহর। আকাশে বাতাসে তখন আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আর্থারের অবশ্য প্রথমেই অত খেয়াল ছিল না। কোনোমতে একটা চাকরি জুটিয়ে মধ্য লন্ডনের গ্রেস ইন রোডে একটা আস্তানাও জুটে গেল। অবশ্য একা নয়, তারই মতো উঠতি কয়েকজন কল্পবিজ্ঞান লেখক হওয়ার স্বপ্নে মশগুল তরুণের সঙ্গে।
লেখা কিন্তু তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। অ্যামেচার সায়েন্স ফিকশন স্টোরিজ পত্রিকার ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় বের হলো আর্থারের প্রথম কল্পবিজ্ঞান ছোটগল্প ‘ট্রাভেল বাই ওয়্যার’। ওই পত্রিকারই ১৯৩৮ সালের মার্চ সংখ্যায় বের হলো তার দু-দুটো গল্প ‘হাউ উই ওয়েন্ট টু মার্স’ আর ‘রিট্রিট ফ্রম আর্থ’। ১৯৩৯ সালে নিউ ওয়ার্ল্ড পত্রিকার হেমন্ত সংখ্যায় বের হয় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আর একটি প্রবন্ধ ‘রিভেরি’। চারদিকে ঘোর ডামাডোলের মধ্যেও চলছিল তার নিরলস সাহিত্যসাধনাও। জেনিথ, ফ্যানজিনয, অ্যাস্টউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি পত্রিকায় বেরোতে থাকল একের পর এক গল্প।
তারপর বিশ^যুদ্ধের দামামা বেজে গেল। রাডার বিশেষজ্ঞ হয়ে ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রয়্যাল এয়ারফোর্সে যোগ দিলেন বছর চব্বিশের আর্থার। মূলত অফিসের দেখভাল করতে হতো। কিন্তু বাঁধাধরা কাজে তার মন নেই। সেই রুটিনের বাইরে কাজ করতে গিয়ে বের করে ফেললেন ‘ব্ল্যাইড ল্যান্ডিং রাডার সিস্টেম’। যা থেকে আজকের বিমান অবতরণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হয়েছে।
জিও স্টেশনারি অর্বিট বা ভূসমলয় কক্ষপথের ব্যাপারটা তার মাথায় এলো। ১৯৪৫ সালে ওয়্যারলেস ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় লিখে ফেললেন ‘ক্যান রকেট স্টেশন গিভ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রেডিও কভারেজ।’ প্রবন্ধের শেষে উপসংহারে লিখলেন, “বিশ^জুড়ে সব ধরনের পরিষেবা দিতে হলে এটা একমাত্র উপায়। এ ছাড়া এটাই সম্প্রচারের পক্ষে সবচেয়ে সুলভ রাস্তা।”
এই একটা প্রবন্ধ লিখেই থেমে থাকলেন না আর্থার। রকেট আর মহাকাশযান নিয়ে একের পর এক লিখে চললেন। ১৯৫০ সালে লিখলেন ‘ইন্টাপ্লানেটরি ফ্লাইটস: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু অ্যাস্ট্রোনটিক্স’, ‘১৯৫১ সালে এক্সপ্লোরেশন অব স্পেস,’ আর ১৯৬৮ সালে ‘প্রমিজেস অব স্পেস’।
জিও স্টেশনারি অর্বিটের ব্যাপার কী? এটা হলো পৃথিবীর ৩৫,৮০০ কিলোমিটার ওপরে বিষুবরেখা বরাবর এমন এক কক্ষপথ, যেখানে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে মিলিয়ে এটিও ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিম থেকে পুবে পাক খায়। একে ক্লার্কস অর্বিট বা ক্লার্কের কক্ষপথ হিসেবে নামাঙ্কিতও করা হয়।
এই ভূসমলয় কক্ষপথ বিশ্বের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এনে দিয়েছে বললে কম বলা হয়। যাবতীয় যোগাযোগ উপগ্রহ এখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। আজকের পৃথিবীর যাবতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা-ফোন থেকে হাই স্পিড ব্রডব্যান্ডের সূতিকাগার এই কক্ষপথ। টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারও সম্ভব হয়েছে এর ফলেই।
এতেই শেষ নয়, ১৯৫৫ সাল নাগাদ তৎকালীন মার্কিন আবহাওয়া দপ্তরের প্রধান হ্যারি ওয়েক্সলারকে আর্থার একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠির ফলেই রকেট ও উপগ্রহকে ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া শুরু হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শুধু টেলিযোগাযোগ নয়, আবহবিজ্ঞানের খোলনলচেও পাল্টে যায় আর্থারের দূরদর্শিতায়।
আর্থারের বৈজ্ঞানিক দূরদর্শিতা যে কত দূর তার হাতে-কলমে প্রমাণ বিশ্ববাসী পেল ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে। ওই বছরের ১৯ আগস্ট মার্কিন উৎক্ষেপণ কেন্দ্র কেপ কানাভেরাল থেকে ডেল্টা ডি রকেটে চেপে সিনকম ৩ উপগ্রহ পাঠানো হয় ভ‚সমলয় কক্ষপথে। ফলস্বরূপ ১০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ববাসী টোকিও অলিম্পিকের সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পায়। বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চারশ উপগ্রহ রয়েছে এই ভূসমলয় কক্ষপথে।
ক্লার্ককে নানান সম্মানে ভূষিত করা হয়। যেমন রিন্ডেবার্গ পুরস্কার, ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউটের স্বর্ণ পদক, সকোনি পুরস্কার, আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিক্রম সারাভাই অধ্যাপকপদ, লন্ডনের কিংস কলেজের ফেলোশিপ প্রভৃতি। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে তার মহাকাশ জ্ঞানের স্বীকৃতিস্বরূপ এক বিরল সম্মানও দিয়েছে।
মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যকার গ্রহাণুপুঞ্জের বলয়ে থাকা একটি গ্রহাণুর নাম দিয়েছে গ্রহাণু ৪৯২৩ ক্লার্ক। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদরা ডাইনোসরের এক প্রজাতির নাম দেন সেরেন্ডিপাসেরাটপস আর্থারক্লার্নি। নোবেল পুরস্কারের জন্যও তার নাম মনোনীত হয়। ২০০০ সালে ইংল্যান্ডের রানি তাকে নাইটহুড দেন। তিনি হলেন স্যার আর্থার সি ক্লার্ক।
আমরা ফের ফিরে আসি তরুণ আর্থারের জীবনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। অর্থাভাবে কলেজে পড়া হয়নি বলে বেশ দুঃখ ছিল আর্থারের। এবার তা মেটাতে উদ্যোগী হলেন। অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যায় অনার্স পড়তে ভর্তি হলেন লন্ডনের কিংস কলেজে। রীতিমতো প্রথম বিভাগে পাস করে বেরোলেন ১৯৪৮-এ। ফলে এবার আর চাকরি জোটাতে খুব একটা সমস্যা হলো না। ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে বের হতো ফিজিক্স অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পত্রিকা, সেখানেই সহকারী সম্পাদকের কাজ জুটে গেল।
অবশ্য পড়াশোনার মধ্যেও লেখালেখি কিন্তু বিসর্জন দেননি। ১৯৪৭-এর গ্রীষ্মের ছুটিতে লিখে ফেললেন তার প্রথম উপন্যাস ‘প্রিলুড টু স্পেস’। হয়তো একটু বেশি প্রযুক্তির কচকচানি রয়েছে গল্পে, কিন্তু কাহিনির নির্যাস চমকে দেওয়ার মতো। বিশ্বের প্রথম মহাকাশযান হিসেবে প্রমিথিউস চলেছে চক্রডিয়ানে, মহাকাশযানে রয়েছে আলফা আর বিটা নামে দুটি যন্ত্র। একটি মহাকাশযানকে চাঁদের কাছে নিয়ে যাবে, অন্য যন্ত্রটি পরমাণুচালিত, স্বয়ংক্রিয় হয়ে নানান কাজ করতে পারে। ঠিক এখনকার দিনে মহাকাশযানের মতো, যে কিনা অজানা গ্রহে নেমে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, প্রয়োজনমতো ছবি তোলে, নুড়ি পাথর জোগাড় করে পৃথিবীতে আনে গবেষণার জন্য।
মনে রাখতে হবে আর্থার লিখছেন ১৯৪৭ সালে আর প্রথম সফল চন্দ্রাভিযান হয় তার পাক্কা বারো বছর পরে যখন ১৯৫৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত মহাকাশযান লুনা ২ চাঁদে অবতরণ করে। তাই আসল ঘটনা ঘটার এক যুগ আগেই রোভারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো।
প্রথম উপন্যাস লেখার পর তরুণ আর্থারের নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। লিখেই যে পেট চালানো যাবে সেই ভরসা মনে এলো। তাই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ১৯৫০-এ তিনি পুরোদস্তুর লেখক হয়ে গেলেন। ২০০৮ সালে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আর কোনোদিন ধরাবাঁধা চাকরি করেননি।
কল্পবিজ্ঞানের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে খ্যাত ক্লার্ক লিখেছেন প্রচুর। ছয় দশকের লেখক জীবনে লিখেছেন শ’খানেক বই যার মধ্যে গোটা বাইশেক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি। এর মধ্যে চাইল্ডহুডস এন্ড, ২০০১ আ স্পেস ওডিসি, আ ফল অব মুনডাস্ট, রঁদেভু উইথ রামা, দ্য ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইস, দ্য ডিপ রেঞ্জ, আর্থলাইট, দ্য হ্যামার অব গড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে তার মৌলিক গবেষণার ওপর অজস্র প্রবন্ধ আর কল্পবিজ্ঞানের ওপর শতাধিক ছোটগল্প। আইজ্যাক অ্যাসিমভ আর রবার্ট হেইনলিনের সঙ্গে তাকেও কল্পবিজ্ঞানের তিন মহারথী হিসেবে গণ্য করা হয়।
গ্রহান্তরের প্রাণীদের নিয়ে এইচ জি ওয়েলস বা বব শয়ের মতো ক্লার্কেরও ছিল অদম্য কৌতূহল। তার কথায়, “এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের মতো আরও প্রাণী আছে, না আমরাই সবেধন নীলমণি, দুটো তথ্যই ভয়ঙ্কর।” এমনকি মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার ৯০তম জন্মদিনে তিনি তার যে শেষ তিনটি ইচ্ছার কথা বলেছিলেন- তার মধ্যে একটি ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে এই আদি অন্তহীন কৌতূহলের অবসান।
সিনেমা ও সম্প্রচারেও ক্লার্ক ছিলেন তুখোড়। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত সেন্টিনেল গল্পের ওপর ভিত্তি করে স্ট্যানলি কুব্রিকের সঙ্গে ২০০১ আ স্পেস ওডিসির চিত্রনাট্য লেখেন। অ্যাপোলো-১১ যখন চাঁদে অবতরণ করে তখন মার্কিন নেটওয়ার্ক সিবিএসের ওয়াল্টার কনক্রাইটের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন ক্লার্ক। ১৯৮০ সালে আইটিভিতে ১৩টি এপিসোডে করেন ‘আর্থার সি ক্লার্কস মিস্টেরিয়াস ওয়ার্ল্ড’।
এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ১৯৮৫ সালে ফের ১৩টি এপিসোডে অলৌকিক ঘটনা নিয়ে প্রচারিত হয় ‘আর্থার সি ক্লার্কস ওয়ার্ল্ড অব স্ট্রেঞ্জ পাওয়ারস’। এর প্রায় এক দশক বাদে ১৯৯৪-এর জুলাই মাসে বিশ্বের নানান অজানা রহস্য নিয়ে ডিসকভারি চ্যানেল নিয়ে আসে ২৬ এপিসোডের ‘আর্থার সি ক্লার্কস মিস্টেরিয়াস ইউনিভার্স’।
আসলে ক্লার্ককে শুধু কল্পবিজ্ঞানের পরিধি দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ১৯৫৮ সালে ক্লার্ক তার ভবিষ্যদ্বাণীর এক স্মরণিকা প্রকাশ করেন। সেখানে চোখ রাখলে চমকে যেতে হয়। ১৯৯০ সাল নাগাদ তিনি ব্যক্তিগতভাবে রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করতে পারার কথা বলছেন। সত্যিই রেডিও তরঙ্গের ফলিত প্রয়োগ মোবাইল টেলিযোগাযোগ নব্বইয়ের দশকে পৃথিবী কাঁপিয়ে দেয়।
তার বলা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স আজ সত্যি সত্যিই নানান শিল্পে কাজ করতে শুরু করেছে। ৬০ দশকেই ক্লার্ক কম্পিউটারের ব্যক্তিগত কাজে লাগার বিষয়ে বলেছিলেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়েছে। ভার্চুয়াল জগতে তথ্যভাণ্ডার রাখার কথা বারংবার তার লেখায় এসেছে। আজকের ক্লাউডের তথ্যভাণ্ডার তো আদতে সেটাই।
নেটদুনিয়ার কথাও তো উল্লিখিত হয়েছে বারংবার। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা ডব্লিউডব্লিউডব্লিউর আবিষ্কর্তা টিম বার্নাস লি অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন ক্লার্কের ‘ডায়াল এফ ফর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ পড়ে। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এই গল্পের এক চরিত্র গণিতজ্ঞ জন উইলিয়ামস বিশ্বের সমস্ত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা একত্রীকরণের কথা বলেছেন। যেন একটাই মস্তিষ্ক চালনা করছে পুরো ব্যবস্থাটাকে। অর্থাৎ বিশ্ব টেলিযোগাযোগ এক অতিকায় মস্তিষ্ক। ঠিক এই তত্ত্বটাই বার্নার্স লিকে ভাবায়, ফলশ্রুতি নেটদুনিয়া বিশ্বব্যাপী বিস্তার।
মানুষ এখন আর শুধু চাঁদে নেমেই সন্তুষ্ট থাকছে না, মঙ্গলেও নামার তোড়জোড় করছে। চিন্তাভাবনা চলছে কীভাবে চাঁদের বুকে বসতি গড়া যায়, কীভাবে সেই বসতিকে বেস করে অন্য বাসযোগ্য গ্রহগুলোতে বসতি স্থাপন করা যায়। পৃথিবীর বাইরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র তো আদতে সেই চিন্তাভাবনারই প্রাথমিক ধাপ।
ক্লার্কের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে স্পেস ট্রাভেলের বাণিজ্যিক দিকও এখন সামনে চলে এসেছে। ইলন মাস্কের সংস্থা, ভার্জিন শিল্পগোষ্ঠীর সংস্থা এখন মহাকাশ পর্যটনের ব্যবস্থা করছে। আপাতত আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র হবে এই সব পর্যটনের গন্তব্যস্থল। পরে তা চাঁদ আর মঙ্গলেও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি অন্যগ্রহ থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
ক্লার্কের ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইসে যে স্পেস এলিভেটরের কথা বলা হয়েছে তারও বাস্তবরূপ কীভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এটা সম্ভব হলে শুধু যে মহাকাশে যাওয়া সহজ হবে তাই নয়, ভিন্ন গ্রহের সঙ্গে পণ্য বিনিময়ও অনেক সহজ ও সুলভ হয়ে যাবে।
১৯৫১ সালে ক্লার্কের লেখা ‘এক্সপ্লোরেশন অব স্পেস’ পড়ে অভিভ‚ত হন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার রকেট ডিজাইনার ওয়ার্নার ভন ব্রাউন। এর সাহায্যে ৬০ দশকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তিনি মার্কিনিদের চাঁদে অভিযানের যৌক্তিকতা বোঝান। ওই দশকের শেষেই নীল আর্মস্ট্রং পা রাখেন চাঁদে।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মার্কিন কংগ্রেসে এক ভাষণে ক্লার্ক বলেন, “আমি নিশ্চিত যে ওয়েলস ও ভার্নের মতো যারা এটা নিয়ে লিখছেন তারা না লিখলে, লোকে এ নিয়ে না ভাবালে মানুষ আজ চাঁদে পা রাখতে পারত না। একইভাবে আমার গর্ব হয় এটা জেনে যে আমার চেনা অনেক নভোচরই নভোচর হয়েছেন আমার বই পড়ে।”
বিশ্বদরবারে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার কার্যত দূত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আর্থার সি ক্লার্ক। ১৯৫৪ সাল। অতল জলের আহ্বান অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে অভিযান চালাতে এসএস হিমালয় জাহাজে চড়ে লন্ডন থেকে সিডনি যাচ্ছেন ক্লার্ক। কলম্বো বন্দরে একদিনের জন্য নোঙর করল জাহাজ। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপকে দেখেই তার প্রেমে পড়লেন। সেই প্রেম বজায় ছিল আমৃত্যু। সে যাত্রায় ক্লার্কের সঙ্গে আলাপ হলো শ্রীলংকার নামজাদা ডাইভার রডনি জঙ্কলাসের সঙ্গে। জাহাজ পাড়ি জমাল সিডনির উদ্দেশে।
কিন্তু শ্রীলংকা তার মন থেকে গেল না। বছর দুই বাদে ক্লার্ক ফের পা রাখলেন দ্বীপরাষ্ট্রে, সঙ্গী আরেক ইংরেজ মাইক উইলসন। এবার শ্রীলংকাকে নিজের চোখে দেখতে, জানতে চাইলেন ক্লার্ক। বুঝতে চাইলেন এর হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে, উপলব্ধি করতে চাইলেন এর সংস্কৃতিকে। ঘোরাঘুরি শেষে কলম্বোতেই থিতু হলেন। তারপর দেখতে দেখতে ৫২ বছর কেটে গেল। শ্রীলংকাই হয়ে উঠল তার দ্বিতীয় স্বদেশ। একবার পরিহাস করে বলেছিলেন, “দু-এক সপ্তাহ থাকার পর এখান থেকে চলে যাওয়া যায়।
তারপর থাকলে আর ফেরা যায় না।” ক্লার্কেরও বোধহয় তরুণী মেরলিন মেফিল্ডের সঙ্গে ১১ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক ১৯৬৪ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শ্রীলংকায় তার ব্যবসায়িক সঙ্গী হেক্টর একনায়েকের পরিবারই হয়ে উঠেছিল তার নিকটজন। এদেরই তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। ১৯৯৫-এর পর থেকে ক্লার্ক কার্যত হুইলচেয়ারে বন্দি হয়ে পড়েন পোলিও পরবর্তী জটিলতায়। ২০০৮ সালের ১ মার্চ যখন তিনি কলম্বোতে প্রয়াত হলেন, তখন তার পাশে রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রে তার বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধরা।
তার লেখায় বারংবার পটভ‚মি হয়েছে দ্বীপরাষ্ট্র। শ্রীলংকার প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরকে পটভূমি করে ১৯৫৭ সালে লিখলেন ‘দ্য ডিপ রেঞ্জ’। কলম্বোর বিখ্যাত গল ফেস হোটেলে বসে লিখে ফেললেন ‘৩০০১ ফাইনাল ওডিসি’। উত্তর-মধ্য শ্রীলংকার প্রাচীন সিগ্রিয়া শহরের প্রাচীন দুর্গকে পটভূমি করে ১৯৭৯ সালে লিখে ফেললেন ‘ফাউন্টেনস অব প্যারাডাইস’।
২০০৮ সালে জীবনের শেষ উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট থিয়োরেম’ শুরুই হয়েছে দ্বীপের উত্তর-পূর্ব উপকূলের বন্দর শহর ত্রিঙ্কোমালিতে। দেশের মোরাতুয়া প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্য হয়ে রইলেন দীর্ঘ ২৩ বছর, ১৯৭৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। বিশ্বখ্যাত এই অতিথির সম্মানে শ্রীলংকা সরকার ১৯৯৮ সালে দুটো ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ২০০৫ সালে দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা শ্রীলংকাভিমণ্য’তে ভূষিত করা হয় তাকে।
ভারতেও উপগ্রহের সাহায্যে ১৯৭৪ সালে টিভি সম্প্রচার ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেন ক্লার্ক। পরের বছর ভারত তাকে ডিশ অ্যান্টেনা উপহার দেয়। ফলে শ্রীলংকায় ক্লার্কের বাড়িতে প্রথম উপগ্রহের মাধ্যমে টিভি আসে। কলম্বোতে ক্লার্কের সমাধিতে লেখা- তিনি আর বড়ই হলেন না। আসলে তার বড় হওয়া থামেইনি। ক্লার্কের সারা জীবনের নির্যাস বোধহয় ওই কটি কথায় রয়েছে।
লেখক: অনুবাদক