মুহম্মদ খসরু: শহরের শেষ প্রথাবিরোধী ‘সিনেমাপাগল’

আরশাদ সিদ্দিকী
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ১২:১৩

চলচ্চিত্র যোদ্ধা মুহম্মদ খসরু।
শহর ছেড়ে গিয়েও হয়তো শান্তি হয়নি। তাই আরো দূরে যাওয়া। এই শহরে আর কোনো প্রথাবিরোধী ‘সিনেমাপাগল’ নেই। দূরের কোনো গ্রামেও নেই। উচ্চকোটির-ভদ্রলোকের শহরে এবার শিল্প হবে, সিনেমা হবে কিনা আমার জানা নেই। তবে মুহম্মদ খসরুকে এ ভূ-ভাগের সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে অস্বীকার করা যাবে না। তার নাম মুছে দেয়া যাবে না। ১৯৬৩ সালে যাদের হাতে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ গঠিত হয় মুহম্মদ খসরু তাদের মধ্যে ছিলেন অগ্রণী।
এ শহর প্রথাবিরোধীর নয়। সে তো জানা হয়েছিলো আগেই। প্রথাবিরোধীকে তো নয়ই, প্রথাবিরোধিতাও সইতে পারে না। তাও শিল্পের মতো মহান-মহৎ-পবিত্র-উচ্চকোটির বিষয়-আশয় নিয়ে লোকটা বকে যাবে। ভাষার শূচিতায় শপাং চাবুক চালাবে। অসভ্যের মতো মদ খেয়ে খিস্তি মেরে যাবে। সিনেমা-টিনেমার স্বপ্ন দেখবে, অথচ হাত-পা ধরাধরি করে মালকড়ি জোগাড় করতে পারবে না, তো তাকে তো যেতেই হবে শহর ছেড়ে। এ শহরে তো জাত কেনা যায়। এ প্রথাবিরোধীর তা জানা ছিলো না।
শহর ছেড়ে গিয়েও হয়তো শান্তি হয়নি। তাই আরো দূরে যাওয়া। এই শহরে আর কোনো প্রথাবিরোধী সিনেমাপাগল নেই। দূরের কোনো গ্রামেও নেই। উচ্চকোটির-ভদ্রলোকের শহরে এবার শিল্প হবে, সিনেমা হবে কিনা আমার জানা নেই। তবে মুহম্মদ খসরুকে এ ভূ-ভাগের সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে অস্বীকার করা যাবে না। তার নাম মুছে দেয়া যাবে না। ১৯৬৩ সালে যাদের হাতে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ গঠিত হয় মুহম্মদ খসরু তাদের মধ্যে ছিলেন অগ্রণী।
মুহম্মদ খসরু জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালে। ভারতের হুগলী জেলায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার অদূরে। কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে। তার বাবা কাজ করতেন হুগলী জুট মিলে। পঞ্চাশের দশকে দাঙ্গার কারণে পরিবারসহ দেশে ফেরা।
পেশাগত জীবন শুরু ফটোগ্রাফার হিসেবে। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানরা বিসিক গড়ে তুললে তাকে প্রায় জবরদস্তি নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তার রক্তে ছিল সিনেমার নেশা। ফটোগ্রাফার পরিচয় ছাপিয়ে তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিনেমা-সংগঠক।
সিনেমা নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা কাজের শুরু ১৯৬৮ সালে। তৎকালীন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরু সিনেমার কাগজ ‘ধ্রুপদী’ প্রকাশ করেন। ২০০৬ সালে ‘ধ্রুপদী’ শেষ সংকলন প্রকাশ পায়। মাত্র ছয়টি সংখ্যা প্রকাশ পায় ধ্রুপদীর।
ধ্রুপদী- ছাড়াও চলচ্চিত্রপত্র, ক্যামেরা যখন রাইফেলসহ বেশ ক’টি প্রকাশনা সম্পাদনা করেছেন মুহম্মদ খসরু। মুহম্মদ খসরু ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন সিনেমাবিষয়ক সাহিত্যের পাঠাগার। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিল্ম স্টাডি সেন্টার।
১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তাকে শেষ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কিছুকাল তাকে কাজ করতে হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবে।
বাংলাদেশে প্রথম শর্টফিল্ম নির্মাণেও মুহম্মদ খসরুর ভূমিকা ছিলো। ১৯৭৫ সালে ভারতের রাজেন তরফদার পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘পালঙ্ক’-তে মুহম্মদ খসরু কাজ করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে।
নিজে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য জমাও দিয়েছেন দু’বার। কিন্তু অনুদান মেলেনি। শেষতক আর তার স্বপ্নের সিনেমা বানানো হয়নি।
প্রথাবিরোধী এ সিনেমা পাগলকে সম্মানিত করা হয় হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তী পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের আজীবন সম্মাননার মাধ্যমে।
মুহম্মদ খসরুর শেষজীবন কেটেছে নিভৃতে, কেরানীগঞ্জের মোহনপুর গ্রামে। প্রথাবিরোধী সিনেমাপাগল হয়েই জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন গত বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রথাবদ্ধ সংসার করা হয়নি। সারাজীবন কেটে গেছে সিরিয়াস সিনেমার ঘোরে।