
ঋত্বিক ঘটক। ছবি: সংগৃহীত
ঋত্বিক ঘটক যা বলতে চেয়েছেন, সেই বলার মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। তিনি যা বলতে চান, সেই বলাটা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি জানতেন এই একটি মাধ্যমেই নিজের কথাটুকু সরাসরি বলা যায়। শিল্পের আর মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।
মানুষকে ভালোবাসি আমি পাগলের মতো। মানুষের জন্যই সবকিছু। মানুষই শেষ কথা। সব শিল্পেরই শেষ পর্যায়ে মানুষে পৌঁছাতে হয়। কথাটি বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক (৪ নভেম্বর ১৯২৫-৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬)। শুধু কথার কথাতেই নয়, কথাটিকে তিনি জীবন ও কর্মে ধারণ করেছেন। প্রখ্যাত এই চলচ্চিত্রকার তার চলচ্চিত্রেও বারবার মানুষকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়। আদি নিবাস পাবনা জেলার ভারেঙ্গায়। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক, ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি কবিতা এবং নাটকও লিখতেন। মা ইন্দুবালা দেবী। ঋত্বিক ঘটক আইএ পাস করেন রাজশাহী কলেজ থেকে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়েই তাদের পরিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইংরেজি সাহিত্যে। তবে আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করেননি।
১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম নাটক লেখেন ‘কালো সায়র’। ১৯৫১ সালে যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের (আইপিটিএ) সঙ্গে। শুরু হয় নাটক লেখা, পরিচালনা ও অভিনয়। একই বছর চলচ্চিত্র জগতে পা দেন। কাজ করেন ‘ছিন্নমূল’ ছবিতে। নিমাই ঘোষের এই ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।
নিজের পরিচালিত প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। আর্থিক সংকটে ছবিটি যথাসময়ে মুক্তি পায়নি, এটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। পরে নির্মাণ করেন ‘অযান্ত্রিক’। মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। অযান্ত্রিক এনে দেয় খ্যাতি। সেই সঙ্গে খুলে দেয় নতুন দিগন্তও। একজন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক নিয়ে তৈরি সিনেমাটি ভারত জুড়ে সাড়া ফেলে। ছবিটি সুবোধ ঘোষের একটি ছোটগল্প থেকে নির্মাণ করা।
ঋত্বিক ঘটক যা বলতে চেয়েছেন, সেই বলার মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। তিনি যা বলতে চান, সেই বলাটা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি জানতেন এই একটি মাধ্যমেই নিজের কথাটুকু সরাসরি বলা যায়। শিল্পের আর মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। অথচ ৫০ বছরের জীবনে তিনি সিনেমা বানিয়েছেন সবে ৮টি। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় ‘বাড়ি থেকে পলিয়ে’।
এরপর ১৯৬১ সালে মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার এবং ১৯৬২ সালে সুবর্ণরেখা। ট্রিলজি হিসেবে খ্যাত এই তিনটি চলচ্চিত্রে উঠে আসে তৎকালীন কলকাতার অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রূঢ় বাস্তবতা। অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। চলচ্চিত্রকে তিনি ব্যবহার করেছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে।
এই আটটি ছবির সবগুলোতেই সমাজ পরিবর্তন, নিজের ভাবনা এবং মানুষের জন্য ভালোবাসা উঠে এসেছে। ‘আমাদের ফেলো না’ শিরোনামের কবিতায় তিনি বলেছিলেন, “মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।/এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার/বদলে গেছে,/তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে।/মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।’ মানুষের প্রতি তার এ ভালোবাসাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। নির্মাণ করিয়ে নিয়েছে চলচ্চিত্র। তার আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’।
নিজের লেখা কাহিনি অবলম্বনে তৈরি। ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ছবির মূল চরিত্র নীলকণ্ঠ বাগচী, এক মাতাল বুদ্ধিজীবী। যে তার বন্ধুদের মতো সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। আত্মজৈবনিক হলেও দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সময়ের এক নির্মম সমালোচনাও বটে। এই চলচ্চিত্রেই নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে উঠে আসে চরম উপহাস ভরা বাক্য, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো।”
তার ছবিতে আছে ব্যক্তিজীবনের নানা ঘাত অভিঘাত। আছে একাকিত্বের যন্ত্রণা। সিনেমা বানানোকে তিনি শুধু শিল্প হিসেবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। নিজের দর্শনের সঙ্গেও তিনি আপস করেননি। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ঋত্বিক ঘটককে তুলনা করা হয় সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি দুটি উপন্যাস, কিছু নাটক, কয়েকটি ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্র ও শিল্পকলা বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সম্পাদনা করতেন ‘অভিধারা’ ও ‘অভিনয়দর্পণ’ নামের দুটি পত্রিকা।
ঋত্বিক ঘটক জানতেন, ‘একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা এখনই বলতে চলচ্চিত্রই একমাত্র মাধ্যম।’ সেই হাতিয়ারকে তিনি যথাযথভাবে মানুষের কাজে লাগিয়েছেন। যা চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে যেমন ঝাঁকুনি দিয়েছে তেমনি নাড়া দিয়েছে মানুষের হৃদয়।