
অনুগল্প। প্রতীকী ছবি
পাখি
তার ঘুম আসে না।
রাত তৃতীয় প্রহরে যখন সবদিকে সবাই এবং সবকিছু ঘুমিয়ে পড়ে, তখন কেবল পাখি, কীট-পতঙ্গ আর সে জেগে থাকে। সে জেগে থাকে কীট-পতঙ্গ আর পাখির ডাকের ভেতর।
বাগানবাড়ির পেছনে পোঁতা পাম্প-মেশিন ঘেঁষে ছোট একটা দোচালা ঘর। সেই ঘরের একপাশে রাখা কৃষি-যন্ত্রপাতিসহ কিছু পরিত্যক্ত জিনিস, আর অন্যদিকে পাতা ছোট একটা চৌকি। ওখানেই চৌদ্দ দিনের জন্য ঠাঁই হয়েছে তার।
গৃহকর্মী সালমা দিনে তিনবার খাবার নিয়ে আসে। জ্বর আর সর্দি-কাশির কিছু ওষুধও দিয়ে গেছে।
বাগিচার এদিকে অন্য আর কেউই আসে না।
রাতে পতঙ্গগুলো এত চেঁচায়! ওগুলো যেন একটাই কথা চিৎকার করে বলে, মানুষ যেমন কোনোকিছু মানতে না চাইলে ক্রোধের সঙ্গে ‘না’ বলে, ওরা সেভাবেই অবিরাম চেঁচিয়ে যায়। অবশ্য কোনো কোনোটা শব্দ করে চিকন বাঁশির মতো স্বরে। তবে পাখিরা কথা একটু বেশিই বলে। যে পাখিটা সুর করে মি-ঠু মি-ঠু ডাকে, সে যেন তার ছোট্ট বাচ্চাটাকে খোঁজে, কোথাও গিয়ে সে আর ফিরছেই না। বউ কথা কও পাখিটা যে একটাই কথা বলে, এমন না। সে যখন একা একা কথা বলে, তখন নিজেই প্রশ্ন করে আর নিজেই উত্তর দেয়:
যাচ্ছ কোথায়?
বাণিজ্যে যাই।
ফিরবা কবে?
জানা তো নাই।
ঘরের মানুষ?
রইল পড়ে।
সে খুব বিষণ্ন আর একা বোধ করে। শ্বাসকষ্ট বাড়ে। ঘুম আসে না।
এদিকে আসে না প্রায় কেউই।
এক রাতে চোখ গেল পাখিটা তাকে আরও দুঃখের ভেতর ঠেলে দিয়ে বলতে থাকে: মন গেল... প্রাণ গেল... শ্বাস গেল, সব গেল...!
সালমা এক ভোরবেলা এসে তার কোনো সাড়াশব্দ পায় না। সে কি ঘুমাচ্ছে? একদিন সে অনুনয় করে বলেছিল, আমি কি মরে যাব!
সালমা উঠানের দিকে দৌড়ায়। আর সে তখন বাতাসের ভেতর বাতাস হয়ে উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে তার নিজের পায়ের চিহ্ন মুছে দিয়ে।
একটা পাখি তখনো নিজের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে:
যাচ্ছ কোথায়?
বাড়িতে যাই।
বাড়ি কোথায়?
ভুবনডাঙ্গা।
ফিরবা কবে?
মনে তো নাই।
মানুষ
জেলঘুঘু রাত ঠেলে ঠেলে ভোরের দিকে যাচ্ছিল। আলো ফুটছে।
জইশস্যের খেতের ধারে দাঁড়িয়ে ফাঁদে পড়া কাকগুলোকে সে দেখে। ওরা বুঝে গেছে, এ ফাঁদ থেকে বেরুনো যাবে না। তাই কারও মধ্যে একবিন্দু চাঞ্চল্য নেই, যেন ভবিতব্যটাকে নিরুপায়ভাবে মেনে নিয়েছে।
জেলঘুঘু খেয়াল করল, ফাঁদে-পড়া একটা বয়স্ক কাক তাকেই দেখছে। অবোধ নয় মোটেও, বুদ্ধিদীপ্ত এবং স্বচ্ছ চোখ, সেখানে চিনতে পারার আলো।
‘কী ভাবছো?’ কাক জিগ্যেস করে।
‘ভাবছি, কীভাবে তোমরা ফাঁদে পড়ো,’ জেলঘুঘু জবাব দেয়।
‘মইয়ের ফাঁক গলে নিচের দিকে নেমে যাই, এটা ভেবে যে একই পথে বেরিয়ে যেতে পারব; কিন্তু বেরুনোর সময় ওপরের দিকে উড়তে হয়, তখন ডানা দুটি থাকে ছড়ানো, ওই ফাঁক দিয়ে আর বেরুনো যায় না। এ রহস্যটা জানা থাকলে কখনোই ঢুকতাম না।’
জেলঘুঘু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কাকের সঙ্গে সম্মত হয়ে বলে, ‘আমি জানি তোমরা ঢুকতে না। কখনোই ঢুকতে না, যদি জানতে এই রহস্য। অথচ দ্যাখো, আমি কিন্তু জানি যে, আটকা পড়তে পারি। তারপরও একই কাজগুলো করি, বারবার করি।’
‘বাহ্। কেন করো?’ কাক বিস্ময় প্রকাশ করে।
‘কারণ প্রতিবার মনে হয়, কোনো একটা ব্যতিক্রম ঘটবে, সেই ব্যতিক্রম আর সেই অনিশ্চিত পরিস্থিতি আমাকে বাঁচিয়ে দেবে; যেন আমি ঠিকই বেঁচে যাব।’
মৃত্যুর আগে দুটি চড়ুই
খাঁচায় ঢোকার আগে আমরা ওটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। ঢোকার পথটা দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে যাওয়া ছিল খুব সহজ। কয়েক দফা ঢুকে পাটাতনে ছড়ানো শস্যদানা খেয়ে বেরিয়েও গেছি নির্বিঘ্নে; কিন্তু যখনই উঁচুতে বাঁধা শস্যভরা বাটির সামনে একটা কাঠির উপর বসেছি, অমনি সেটা পড়ে গেল, তখন খুট করে একটা শব্দ হলো। ওটা যে খাঁচা বন্ধ হওয়ার শব্দ, সেটা বুঝলাম যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বেরুবার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম আমরা দু’জনেই আটকা পড়ে গেছি।
লোকটা খাঁচার ভেতরে সুন্দর একটা বাসা বানিয়ে দিলো। একটা কাঠির সামনে বেঁধে দিলো খাবার এবং পানির বাটি। এ ছাড়া বসবার জন্য আরও দুটি লম্বা কাঠি।
খাঁচার ভেতর আমাদের কোনো অভাব ছিল না। শুধু বেশিদূর উড়তে পারতাম না। অবশ্য অনেক কিছুই আমরা হারিয়েছিলাম- কলতলার পাশের উঠানে রোদ পোহানো, ধূলিস্নান, চালকলের পাশের একটা ঘরে আমাদের নিজেদের বানানো বাসা, লেকের ধারের কাঁঠালগাছ থেকে চড়–ইয়ের বড় ঝাঁকের সঙ্গে উড়ে যাওয়া, এসবের কিছুই আর আমাদের ছিল না।
তবু ছোট্ট খাঁচাটিকে আমরা ভালোবাসতে শুরু করলাম। ওখানেই আমরা উড়ে বেড়াই আর পাশে রাখা একুইরিয়ামের রঙিন মাছগুলোকে দেখি।
কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের আতঙ্কিত করে। লোকটা কখনো কখনো বাড়ি ফিরতে ভুলে যায়। তখন খাবার ফুরিয়ে গেলে আমরা না খেয়ে থাকি। আবার বাড়িতে থেকেও কখনো কখনো সে ভুলে যায় আমাদের কথা, তখনো একই সমস্যা হয়। লোকটা কদিন ধরে বাড়ি ফিরছে না, আমরা ভয় পাচ্ছি। সে হয়তো খুব শিগগির ফিরবেও না। ভীষণ আতঙ্কের এই পরিস্থিতিটাকে আমরা বুঝতে চাইছি।
‘কেন এমন হচ্ছে?’ সঙ্গীকে জিগ্যেস করি।
‘আমার ধারণা এখানে দুটি খাঁচা,’ সে বলে।
‘কেমন?’
‘এই যে লোহার খাঁচা, আর লোকটা নিজেও একটা খাঁচা।’
‘কেন?’
‘কারণ তার মনে থাকল কি-না, সে বাড়ি ফিরল কি ফিরল না, তার সময় আছে কি নেই, সে কোথায় আছে- এগুলো মিলে একটা গণ্ডীর ভেতরে আটকে আছি আমরা।’
‘তাহলে বলছো, লোকটা না থাকলে একটা খাঁচা কমল?’
‘কিন্তু ভুলে যেও না, ওই মানুষ-খাঁচাটিতে আমরা বন্দি, ওটা না থাকলে আমরাও নেই।’
‘তার মানে, লোকটা মরলে আমরাও মরব?’
‘হ্যাঁ।’
‘লোকটা বাঁচলে আমরাও বাঁচব?’
‘না, তাকে আমাদের উপযোগী খাঁচা হতে হবে, শুধু বাঁচলেই হবে না- সে হয়তো বেঁচেই আছে, উপযোগী মানে, তাকে থাকতে হবে কাছাকাছি, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, পানি আর খুদ-কুঁড়ো দিতে হবে, কোথাও গিয়ে আটকে পড়া যাবে না, এমনই নানা কিছু।’
‘কিন্তু তা কি সম্ভব?’
‘সম্ভব না, কারণ মানুষ-খাঁচাটা অতো নিখুঁত না।’
‘তাহলে?’
‘শুধু একটুখানি ফাঁক রেখে দিতে হবে, এই লোহার খাঁচায়।’
‘রাখেনি।’
দিগনাগ
একরাতে নাগদত্ত ঘরে ফিরছিলেন। চারদিকে ঘন অন্ধকার। মন্দির চত্বরে এসে খেয়াল করলেন, ভেতরে আলো জ্বলছে। তিনি কৌতূহলী হয়ে একটা স্তম্ভের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলেন ভেতরে।
একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার আলোয় বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন কেউ।
আরও কয়েক পা সামনে গিয়ে নাগদত্ত দেখতে পেলেন, প্রদীপের আলোয় ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছে দিগনাগ এবং সে নগ্ন।
কী করছ দিগনাগ? নাগদত্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।
ধ্যান করছি।
কিন্তু তুমি নগ্ন হয়ে বসেছ কেন?
আমি প্রদীপের আলোয় আমার নগ্ন দেহে পুদ্গল অন্বেষণ করছি।
নাগদত্তের বুঝলেন, দিগনাগ তাকে বিদ্রুপ করতেই এই কাণ্ড করছে। সেদিন বিকালে দুজনের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডা হয়ে গেছে। দিগনাগ পুদ্গলের ধারণা মানতে রাজি নয়। অন্যদিকে পণ্ডিত নাগদত্ত তাকে বুঝিয়েই ছাড়বেন যে, পুদ্গল বা ব্যক্তি এক অনন্য সত্তা, যা না থাকলে কর্ম, পুনর্জন্ম আর নির্বাণের অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
দিগনাগের বিদ্রুপ বিষাক্ত তীরের মতো বিদ্ধ করেছে নাগদত্তকে। তিনি কূপিত হয়ে বললেন, ‘দূর হও, দিগনাগ।’
পণ্ডিত তার ক্রোধ সংবরণ করে বেরিয়ে গেলেন মন্দির থেকে। কিছুক্ষণ পর দিগনাগও গায়ে পোশাক চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
নাগদত্ত রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিলেন না। তার মনে কাঞ্চি থেকে আসা তরুণ দিগনাগের যুক্তিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে আর তিনি মনে মনে সেসব যুক্তির জবাব দিয়ে যাচ্ছেন: ব্যক্তি নিজেও যদি প্রতীত্যসমুৎপন্ন হয়, তবে এমনিতেই সে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তার বাসনাও বিলুপ্ত হবে, তাহলে মন্দ ভবিতব্য নিয়ে আর ভাবনা কিসের? কিন্তু দিগনাগের বিদ্রুপ যে ক্রোধের উদ্রেক ঘটিয়েছে, সেটা কোথায় ঘটল আর এখন যে বিমর্ষতা জন্ম নিচ্ছে, সেই বিমর্ষতা কার?
‘আমি’ কি সত্যিই একটা মায়া? তাহলে ভয়ালদর্শন যে মৃত্যু এখন মাঝে মধ্যেই তাড়া করে, তাকে কে ভয় পাচ্ছে? ভয়টাও কি মায়া? সবকিছুকেই যদি মায়া বলে অস্বীকার করি, তো সেই অস্বীকারটা কে করছে? নাকি আমি যখন মুক্ত হব, তখন আমার সঙ্গে সঙ্গে খোদ অস্বীকারটাও অস্তিত্ব হারাবে? কিন্তু স্বয়ং বুদ্ধ যে দুঃখে কাতর হয়েছিলেন, সেই দুঃখ কোথায় ঘটে? নির্ঘুম রাতের এইসব ভাবনা আর দুর্ভাবনা কোথায় ঘটছে? সেখানে ‘আমি’ যদি না থাকে, তাহলে কী আছে?
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নাগদত্ত তার কুটিরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। গাছতলা একদল মেটেঘুঘু হল্লা করছে। মন্দির চত্বরে এসে বসল কয়েকটি কবুতর।
দিগনাগের সঙ্গে গতকাল যা যা ঘটেছে হঠাৎ সবকিছু মনে পড়ল নাগদত্তের। এসময় তিনি পেছন ফিরতে গিয়ে দেখলেন একটা লতাগাছ জানালাটাকে আঁকড়ে ধরে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে।
নাগদত্ত এটা দেখে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। এই লতাগাছ তো ব্যক্তি নয়, কিন্তু বাঁচার জন্য কীভাবে আঁকড়ে ধরেছে জানালাটাকে- আর ওই মেটেঘুঘু, কবুতর...?
পণ্ডিত সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজলেন দিগনাগকে; কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া গেল না।
একদিন শালিবাহন নামে এক শিষ্য নাগদত্তকে জানাল, দিগনাগ গান্ধার চলে গেছে।