
শওকত আলী। ছবি: সংগৃহীত
বাংলা কথাসাহিত্যে বর্ণিল জগতের স্রষ্টা শওকত আলী। বর্ণনা রীতি ও ভাষা ভঙ্গিমা তার শক্তি। চরিত্রের বর্ণনায় এবং তাদের মুখের সংলাপের ব্যবহারে সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের মানুষকে তুলে আনার অনন্য কারিগর শওকত আলী। জন্ম বিভাগ-পূর্ব বাংলার উত্তরবঙ্গে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬। উত্তর দিনাজপুরের থানাশহর রায়গঞ্জে।
ইংরেজদের শাসনামলে তিনি বেড়ে উঠেছেন ছোট্ট মফস্বল শহরে। বাবা খোরশেদ আলী সরকার পেশায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হলেও যুক্ত ছিলেন কংগ্রেসের সক্রিয় রাজনীতিতে। বাবার রাজনীতি করার সুবাদে বাড়িতে ভালোভাবেই রাজনৈতিক আলোচনা চলত। বাবার বইয়ের সংগ্রহও ছিল সমৃদ্ধ।
মা সালেমা খাতুনও আগ্রহী ছিলেন পড়ালেখায়। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মায়ের উৎসাহেই ছোটবেলাতেই পড়ার আগ্রহ গড়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাকে হারিয়ে শওকত আলী শান্তি খুঁজে পান বইয়ের রাজ্যে। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তির পর তিনি নিজেও জড়িয়ে পড়েন বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেছেন। জেলেও গিয়েছেন। জেলে যাওয়ায় সুযোগ তৈরি হয় জীবনকে ভালোভাবে জানা ও বোঝার।
প্রথম উপন্যাস প্রকাশের প্রায় দশ বছর পর ‘যাত্রা’ উপন্যাসটি প্রকাশ পায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটির জন্য ১৯৭৭ সালে তিনি হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার পান।
‘যাত্রা’ উপন্যাসের কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতম নৃশংস গণহত্যার পরের সময় থেকে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রেক্ষাপটে রেখে সাহিত্য রচনার যে সমৃদ্ধ ধারা, সে ধারায় শওকত আলীর ‘যাত্রা’ অনন্য সংযোজন। ‘যাত্রা’ উপন্যাসের শুরু ২৫ মার্চের পরে। তবে এখানে বিবৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের সময়। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম পর্যায় সময়ে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের অনুভ‚তি, তাদের উদ্বেগ ও আবেগাকুল মনের সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াই।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের যে স্বাভাবিক মনোভাব, তাদের ভেতরে পালিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আকুলতা, জীবনে নেমে আসা হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের অনভিজ্ঞতাকে যাচাই করতে না পারার সংকট, ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে সেইসব বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়েই মানুষের অভিযোজিত মনের লড়াইকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
আমরা যদি ‘যাত্রা’ উপন্যাসের কাহিনির দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব এক ভয়ার্ত পরিবেশের ভেতর থেকে মানুষ পালাচ্ছে ঢাকা শহর ছেড়ে। তারা পালাচ্ছে নদীপথে, নৌকায় বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে। সবার মধ্যেই চেষ্টা কী করে দ্রæত শহর ছেড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তাড়া খাওয়া মানুষ কোথায় যাবে? তাদের গন্তব্য কোথায়? সে কথা কেউ জানে না। শুধু জানে পালাতে হবে।
তাই অনিশ্চিত গন্তব্যকে সামনে রেখেই তাদের পালিয়ে যাওয়া। এই পালিয়ে যাওয়া মানুষের মিছিলের ভেতর থেকে যে মানুষটিকে প্রধান করে তুলেছেন ঔপন্যাসিক শওকত আলী তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান। পালিয়ে যাওয়া মানুষের ভিড়ে তিনিও যুক্ত হয়েছেন সপরিবারে। এক রাতের মধ্যে শত্রু অধিকৃত শহর ঢাকাকে আর কেউ নিরাপদ ভাবতে পারছে না।
সবার মাঝেই প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। অধ্যাপক রায়হানও তাই হানাদার আক্রমণের প্রথম ধাক্কা সামলাতে দুদিন আত্মগোপনে থাকেন স্ত্রী বিনু এবং দুই সন্তানসহ। পরিস্থিতি একটু সয়ে আসার মতো মনে হলেই তিনিও অন্যদের মতো সপরিবারে পালিয়ে যাওয়া স্রোতে মিশে যান।
বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আশ্রয় নেন অচেনা গ্রামের এক স্কুলঘরে। একসময় হানাদার বাহিনী এই গ্রাম অভিমুখে এগোতে থাকে। বাধ্য হয়ে আশ্রয় ছাড়তে বাধ্য হন অধ্যাপক রায়হান এবং অন্য আশ্রিতরা। বিপদে আনাত্মীয়রাই হয়ে ওঠেন স্বজন। পাশাপাশি থাকার প্রত্যয়ে তারাই সন্ধান করেন স্বাভাবিকতার।
জনস্রোতেই অধ্যাপক রায়হানের সঙ্গে দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী লীলা, হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে ইকবাল হলের আহত ছাত্র হাসান, আসেন সখিনা, ফার্নান্ডেজসহ অনেকেই। জীবনের বিশিষ্টতাকে ধারণ করে আসা এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের ভেতরে তখন আলাদা আলাদা স্মৃতি, যার প্রতিটিই দুঃসহ।
যার বর্ণনা রয়েছে এভাবে, ‘দূরে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন হত্যা আর অত্যাচার। হয়তো অন্য কোনো গ্রামের আকাশে তখন ঘর জ্বালানো আগুনের শিখা আকাশমুখী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে কিংবা কে জানে, হয়তো আরেক শহরের আকাশে ধবল জোসনা, নীল তারা আর দক্ষিণের বাতাস আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।’
ঝড়ের প্রাথমিক অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার সময়টুকুর পরই এই মানুষগুলো ধীরে ধীরে ভয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। সংঘবদ্ধ মানুষের মাঝে ঘরে দাঁড়াবার যে প্রবণতা, তা ভেতরে ভেতরে চাপা আগুনের মতো উসকে উঠেছে। স্থিতধী মানুষের ভেতরে জেগে উঠেছে আঘাতের প্রতিবাদে প্রত্যাঘাতের প্রত্যয়। গণহত্যা, প্রাথমিক প্রতিরোধ এবং ব্যক্তিস্বরূপকে চেনার অনন্য সংযোজন শওকত আলীর ‘যাত্রা’।
এখানে প্রধান চরিত্রটির মধ্য দিয়ে উত্থাপিত হয়েছে ব্যক্তি ও ব্যক্তিমনের নিগূঢ় বৈশিষ্ট্য। শওকত আলী তার এই উপন্যাসটি রচনা করেছেন ১৯৭২ সালে। দিনপঞ্জি বা ডায়েরির আদলে লেখা উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ১৯৭৬ সালের দুঃসাহসিকতম সময়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলার পথই যখন রুদ্ধ। অবরুদ্ধ সময়ের বর্ণনাকে ব্যবহার করে লেখা উপন্যাসটির প্রকাশ তাই সাহসিক পদক্ষেপ হিসেবেই চিহ্নিত।
যে মানুষগুলো আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে, তারাই এক অস্থায়ী আশ্রয়ে আক্ষেপ, তাড়না ও যন্ত্রণার তাগিদে ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছে। যা হয়ে উঠেছে সংকটকে সামনে রেখে মানুষের প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার প্রতিফলন। একই সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্র ও ব্যক্তির মনস্তত্তে¡রও নিগূঢ় প্রকাশ হয়ে উঠেছে ‘যাত্রা’।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অধ্যাপক রায়হান মধ্যবিত্ত চরিত্রের সমগ্র সত্তাকেই ধারণ করেন। তিনি রাজনীতি সচেতন রাজনৈতিক কর্মী। যুদ্ধের ভয়াবহতার ভেতরেও তার অন্তরাত্মায় যে মধ্যবিত্ত সুলভ স্বার্থান্ধতা কাজ করেছে, তাও যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শওকত আলী। বিবেকের চঞ্চলতাকেও যে পিছুটানে চাপা দিতে হয়, চলিষ্ণু মধ্যবিত্তের সব আবেগকে যে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না, তারই উদাহরণ অধ্যাপক রায়হান।
তাই পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। নেতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে যুক্তির আশ্রয় খুঁজে তাই বলেন, ‘ভালো লোক খুঁজে বের করেছো তোমরা- আমি বন্দুক ছুঁয়ে দেখিনি জীবনে- আর আমি দেবো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব? তোমাদের মাথা খারাপ নিশ্চয়ই।’
‘যাত্রা’ উপন্যাসে ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতের পর, শহর ছেড়ে দলে দলে মানুষের পালিয়ে, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের ভেতরের পলায়নবাদী মনোভাব, আবার সময়ের তাগিদে সেই একই মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানো, পেছনে ফিরে তাকানোর মধ্য দিয়ে কোনো বিশেষ দিক চিহ্নিত করতে চেয়েছেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে শওকত আলী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রথম যেটা পলায়ন সেটা প্রাণ রক্ষার্থে। জীবন বাঁচানোর জন্য। সেটা জীব মাত্রই করবে। সেটা কাক-পাখি হোক আর মানুষ হোক।
পলায়ন করার পরে যখন সে দাঁড়াবে তখন পুরনো সবকিছুকে ফেলে দেবে কি সে? প্রথমত নিজেকে বাঁচাবে, নিজের সম্পদ, উত্তরাধিকারকে রক্ষা করার জন্য, পুনরুদ্ধার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা সে করবে।’ সেই পুনরুদ্ধারের চেষ্টাই প্রতিফলিত হয়েছে শওকত আলীর যাত্রা উপন্যাসে। মানবিক আবেগের তাড়নায় যে মানুষ ভয়ে পালিয়ে যায়, সময়ের তাগিদে সেই মানুষই ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
কারণ সে জানে, ‘আশাবাদী না হয়ে যে আমাদের গত্যন্তর নেই। ... আমাদের কাছে এখন দুটি মাত্র পথ- হয় মৃত্যু নয়তো লড়াই। যেহেতু একটা জাতি মরে যেতে পারে না- সেহেতু তাকে লড়াই করতে হবে। আর জয়ের আশা না থাকলে কেউ লড়াই করতে পারে না। যেহেতু আমরা মরে যেতে পারি না সেহেতু আমাদের জয়ী হতেই হবে। এখন আমাদের জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা।’
ভাষা ভঙ্গিমা এবং বর্ণনা রীতি শওকত আলীর শক্তি। সেই শক্তিতেই তিনি শিল্পধর্ম অক্ষুণ্ন রেখে ‘যাত্রা’ উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের নিঃসহায়তা, মানবিক মর্মান্তিকতাকে দাঁড় করিয়েছেন।