
প্রতীকী ছবি
গরম আর্দ্র মাটিতে পক্ব হওয়ার পর শিশুটি মৃতের কপাল থেকে ফুটে বেরিয়েছে। আবার অন্যরা বলতে চাইছে যে, না! শিশুটি আগ থেকেই মাটিতে ছিল এবং মৃত ব্যক্তির কপালের পতনই তাকে জাগিয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সত্যটি হলো, শিশুটি তার চোখ থেকে উদয় হয়েছিল।
গর্ভ যেভাবে নবজাতককে নিক্ষেপ করে তেমনি চোখও তাকে নিক্ষেপ করেছে। তাছাড়া অন্যায়ভাবে খুন করা প্রতিটি মানুষের চোখেই মৃত্যুর সময় একটি শিশুর জন্ম হয়।
যুদ্ধ
এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি, মৃত্যুর নিকটবর্তী সে। ক্ষীণ একটা প্রশ্বাসের কাছাকাছি তার নাক। কখনোই এমনটা ভাবেনি। সমস্ত পথপ্রান্তর, জীবন প্রভাতের সুগন্ধি নিয়ে এভাবে সুবাসিত, যেন একমাত্র তার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রভু যেন মাত্রই তার জন্য এসব সৃষ্টি করেছেন, যেন প্রাণভরে প্রশ্বাস নিতে পারে। পাখির পালকে লেগে থাকা জলপ্রপাতের মতো তার বুক ধুয়ে দিতে পারে। মে মাস- তার কপোল, হাতের তালু ও পাঁজর থেকে মুকুলিত হয়েছে। সে তার অনাঘ্রাত ঘ্রাণ নিচ্ছে এবং এগুলো ধারাবাহিক এভাবে তার বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ছে- যা কখনো শুষে যায় না, ঝুঁকে পড়ে না।
কিভাবে মুহূর্তের জন্য তাকে ধারণা করতে চাও যে, মৃত্যুর নিকটে সে। একটি ক্ষীণ বাতাস তার নাকের কাছে? কিন্তু প্রকৃতই সে মৃত্যুর নিকটে ছিল। অনুভব ও ঘ্রাণ নেওয়া ছাড়াই এর একদম কাছে ছিল সে। জীবনকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল বলে মৃত্যুর গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। একবার তারা তাকে বলেছিল, নিশ্চয়ই এটা একটা ভয়ংকর ভুল এবং সে জীবনের কোনো মূল্যই নেই, সর্বদা যা মৃত্যুর বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়; কিন্তু এ নিয়ে সে কোনো পরোয়া করেনি। বরং তার মাঝে ও গভীর এই তত্তে¡র মাঝে তাই, যা কাফন ও মে-র মধ্যে। তার ও মৃত্যুর মাঝে তাই, যা মে মাসের মাটি ও শুষ্কতার মধ্যে।
মে মাস অথবা মে মাস-ছাড়া সর্বদাই সেখানে থাকা সেই ভালোবাসা, মাংসের দেয়াল ও তার স্ত্রী-সন্তান সকলের কাছেই সে অতীত হয়ে গিয়েছিল। সেই পঞ্চভুজ জালিকা, যা দৃঢ় অঙ্গুলি দ্বারা খসখসে ঘরের দেয়ালে বেয়ে ওঠে এবং প্রেরিত সমস্ত সবুজ দিয়ে তা রাঙিয়ে তোলে এবং সেখান থেকে উৎপত্তি করে একটি বৃক্ষের। সেখানে থাকে একটি প্রশস্ত বৃক্ষের ডাল, যা স্ত্রী-সন্তান, মাংস ও ভালোবাসার দেয়ালকে আলিঙ্গন করে নেয়। তার ও মৃত্যুর মাঝে তাই, ভালোবাসা ও মৃত্যুর মাঝে যা।
মূলত এক মুহূর্তের জন্যও সে ভাবেনি যে, তার মাঝে, তার স্ত্রী-সন্তান, ভালোবাসা ও মাংসের দেয়ালের মাঝে পথের বাঁকে দাঁড়ানো মৃত্যুর একটি মুহূর্ত শুধু। যেন অপেক্ষারত বর্শার ফলার মতো তার পরিচিত দশটি নখ। মৃত্যুর একটিমাত্র মুহূর্ত, কিন্তু চ‚ড়ান্ত ও সমাপ্তির।
জানত না, সেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে। যেখানে তাদের মাঝে থেমে ছিল মে মাস। যা হোক, শেষ পর্যন্ত তাকে সেই বাঁক অতিক্রম করে যেতে হয় এবং ক্ষণকাল পরই প্রত্যাশিত ভীতিকর এক কম্পন অনুভ‚ত হয়। তাই ক্ষণিকের জন্য সে তার পদক্ষেপ ধীর করে এবং অদৃশ্য এক চিৎকার শোনে। এসময় যখন তার চোখের সামনে সেই নখগুলো চমকে ওঠে, তখন লড়াই ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি সে। যেন তা অনেক দূরে, বহুকাল আগে ঘটেছে কোনোপ্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই, অনন্তের মতো যা দূরবর্তী। শূন্যতা বা অযৌক্তিকতার বীজের মতো অনাদি।
স্মরণের সীমা ছাড়িয়ে, অনুমানের মাত্রা পেরিয়ে দূরবর্তী; কিন্তু এখন ও সর্বদাই অনুভূতির শক্ত পিঠে বিদ্যমান। প্রতিমুহূর্তে তা থেকে রক্ত ঝরে। জেলি মাছের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে, যার আঘাত তাকে সৈকতের বালিতে ফেলে দেওয়া মৃত্যুর দিকে নিয়ে আসে।
লড়াই! এখনো এর টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে রেখেছে সে। চেতন, অচেতনে যা মিশ্রিত। তখন তার ওপর নখগুলো হামলে পড়েছিল এবং সে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। তারা তার চারপাশে জড়ো হয়েছিল, চামড়া খামচে ধরেছিল। কোমর ও ফুসফুসে নিবদ্ধ হয়েছিল এবং তার রক্তাক্ত জিহ্বা হাঁপাচ্ছিল। ফলে যখনই সে ঘুরছিল, প্রতিবারই নখগুলো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন ও মে-মাসের দ্বারা আবদ্ধ করে রেখেছিল এবং তার চোখ ও নাকের সামনে তরবারির মতো জড়িয়ে গিয়েছিল।
সুতরাং কোনোকিছু দেখতে বা নিশ্বাস নিতে তা তাকে সম্পূর্ণরূপেই বাধা দিচ্ছিল। অথবা এমন একজনের মতো, যে ঘুমুতে যাচ্ছে বা জাগছে এবং সেই নখগুলো সম্বন্ধে কিছু জানে। কিন্তু তার গলা আহত এবং তাতে রক্ত আটকে গেছে। তাই সে আর্তনাদ করে বলে, এমনকি তুমিও? পরমুহূর্তেই সে মৃত্যুর হামাগুড়ি অনুভব করে।
কিন্তু মে ছিল বিশাল আর পথকে সবুজে রাঙিয়ে তুলেছিল। যেখানে সে অনুভব করে আঙুলগুলো তার হৃৎপিণ্ডে ডুবে গেছে এবং তা চিড়ে ফেলেছে। রক্তের স্রোতধারা উড়ন্ত লাল সাপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে তার বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। এরপর রক্ত তার পায়ের কাছে জমা হয় এবং ক্রমান্বয়ে পথের ওপর লাল রঙে প্রবাহিত হয়ে যায়।
তারপর নখগুলো সরে আসে আর সেও তখন অনন্তকালের মতো এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়ায়। অনুভব করে, জীবন তার শরীর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে আর মৃত্যুর অনুভূতি শক্ত ও ভীষণ হয়ে উঠছে, তবু পতিত হতে চাইছে না সে। তাই মুখের ওপর হাত রেখে প্রাণপণে লড়াই করছিল সে। কিন্তু শেষাবধি মৃত্যু ঠিকই এসে পৌঁছায়। তখন তার হাঁটার শব্দ শুনছিল সে এবং তার পদক্ষেপগুলো যেন দূরবর্তী গানের সাথে স্পন্দিত হচ্ছিল। বুঝি স্পষ্টই নিচু থেকে আসছিল তা। তাই নিজের পা দুটো টানতে গিয়ে, সম্পূর্ণ অক্ষমবোধ করে।
এতে মুহূর্তেই বুঝতে পারে, সবকিছুই শেষ হতে চলেছে। সুতরাং তার মাঝে, তার স্বামী-সন্তান এবং ভালোবাসা ও মাংসের দেয়ালের মাঝে তাই, যা তার নাক ও এই প্রশ্বাসের মাঝে। তার ও মে মাসের মাঝে তাই, মে মাসের সবুজ আর রক্তের স্রোতধারার মাঝে যা। অতএব সে ভূপাতিত হয়। তার হাঁটু মাটিতে দুটো গোল গর্ত করে।
হাঁটুতে ভর করে মুখে দু-হাত রেখে বসে থাকে এবং এক মুহূর্ত পর অনুভব করে মে ফিরে এসেছে আর রক্তস্রোত তার প্রস্থানের পথ খুঁজছে। এভাবেই মৃত্যু তার সংগীত নিয়ে তার কোমরের কাছে এসে পৌঁছায় এবং সে পড়ে যায়। তারপর ভীষণ যন্ত্রণায় তার কপাল মাটিতে তড়পে তড়পে একটি গর্ত করে। অবশেষে মৃত্যুর নীরবতা, শহীদ প্রার্থনা করে।
রক্তের স্রোত
অ্যাম্বুলেন্স এসে লাশটিকে কবরস্থানে বা শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে, ঠিক ওই মুহূর্তে ওখানে এমন এক ঘটনা ঘটে, মৃতের চারপাশে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষের কোনো একজনও লক্ষ করেনি যেদিকে। মূলত ওখানে যে জায়গায় তার কপালটি পতিত হয়েছিল, সেখানে পড়ে যাওয়া ওই গোল গর্তে একটি শিশুর জন্ম হয়েছিল।
যদিও এ সম্বন্ধে একজনও ঠিকঠাক জানে না যে, কী করে এ ঘটনাটি ঘটল! ফলে অনেকেই বলছে, গরম আর্দ্র মাটিতে পক্ব হওয়ার পর শিশুটি মৃতের কপাল থেকে ফুটে বেরিয়েছে। আবার অন্যরা বলতে চাইছে যে, না! শিশুটি আগ থেকেই মাটিতে ছিল এবং মৃত ব্যক্তির কপালের পতনই তাকে জাগিয়েছে।
তবে প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সত্যটি হলো, শিশুটি তার চোখ থেকে উদয় হয়েছিল। গর্ভ যেভাবে নবজাতককে নিক্ষেপ করে তেমনি চোখও তাকে নিক্ষেপ করেছে। তাছাড়া অন্যায়ভাবে খুন করা প্রতিটি মানুষের চোখেই মৃত্যুর সময় একটি শিশুর জন্ম হয়। যা হোক, তা সে খুব তাড়াতাড়িই মারা যায়। কেননা একজন ব্যক্তির চোখ থেকে মাটিতে পতনের দূরত্ব দীর্ঘের, যা তার ক্ষীণ, নগণ্য গঠন সহ্য করতে পারে না। তবে, শিশুটি বেঁচে ছিল। কারণ সে বালুতে ডুবে গিয়েছিল। এমনকি সেখানে সে বেঁচে ছিল, কোনো মানুষের অলক্ষ্যেই। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কেউ তাকে পদদলিত করা ছাড়াই।
মানবীয় আকার-আকৃতিসমেত সে ছিল ছোট্ট এক প্রাণী। যাতে তার চেহারাটা এমনই ধারালো, যে কেউ দেখলে ভাববে, তীক্ষ্ন ছেনি দিয়ে পাথর থেকে খোদাই করা হয়েছে। সেই সাথে মুখটা ছিল দৃঢ়ভাবে বন্ধ, তাই সে কথা বলতে পারেনি। চোখের পাতারা ছিল পরস্পর লাগোয়া, তাই দেখতেও পায়নি। বলতে গেলে একটি আঙুলের গিঁটের মতোই ক্ষুদ্র ছিল সে। গায়ের রং ছিল অন্ধকার রাতের মতো কালো। তবে তার হৃদয়টা ছিল ধবধবে সাদা। মূলত তার সমস্ত শরীরে এই একটি অঙ্গই ছিল নির্দোষ শুভ্র।
ফলে যে কেউ তার কালো বুকের দিকে তাকালে দেখে, সেই কালো আন্তঃলক পাঁজরের ভেতর ছোট্ট চড়–ইয়ের ঠোঁটের মতো যেন হৃদয়টা কাঁপছে। এতদসত্ত্বেও ক্ষুদ্র শরীরের গঠনটি ছিল ভারি সমন্বিত, সুদৃঢ় ও অপূর্ব। উভয় হাতের তালুতে আছে দশটি আঙুল। ঠিক যেন মানুষের মতোই প্রত্যকটি আঙুলে রয়েছে তিনটি করে গিঁট।
বক্ষের পেশিগুলো পাঁজরে কালো ঝিনুকের মতো গেঁথে ছিল। তেমনই অন্য সব মানুষের মতো সাধ, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা ও স্মৃতিময়তাও ছিল। সর্বোপরি একজন স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে তার পার্থক্য যা, তা হলো : সে ছিল গঠনে অতিক্ষুদ্র। তার চোখ দুটো ছিল বন্ধ আর ঠোঁট দুটো ছিল পরস্পর মিলিত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে প্রশ্বাস নিচ্ছিল। তার ওপরে ও চারপাশে জমে থাকা বিপুল স্তূপীকৃত মাটি তাকে মেরে ফেলতে পারেনি।
অতএব যেমন কেউ তার জন্ম লক্ষ্য করেনি, তেমনি যখন সে ভেজা বালির গভীরে ডুবে গিয়েছিল তখনো কেউ তাকে এতটুকু খেয়াল করেনি। সুতরাং যখন খননকারীরা মৃতদেহটি কবরস্থানে বা শ্মশানে নিয়ে যায় এবং লোকেরাও ছত্রভঙ্গ হয়, তখন ছোট্ট কালো ওই শরীরের কাঁধের উপর থেকে জনতার পদধ্বনি শোনা যায়।
মূলত তখনই সে আবিষ্কার করে, সে নিঃসঙ্গ এবং কোথাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু হাঁটাচলার প্রবল ইচ্ছা থেকে সে তার পা দমিয়ে রাখতে পারেনি। ফলে পোকার মতো নিজের ছোট ছোট আঙুল দিয়ে সামান্য পথ ফেড়ে সামনে এগিয়ে যায়।
চারপাশ ও ওপরে সেই অজস্র বালুর ঢিবি থাকা সত্বেও কোথাও না থেমে, ক্লান্তিহীন চলতেই থাকে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কোনোপ্রকার নির্দেশনা ও আলো ছাড়াই তার অন্তহীন যাত্রা। যেখানে সে আহার করে বালি, শ্বাস নেয় বালি এবং বালির রসই পান করে। যেখানে সে পেছনে ফিরে তাকায় না, ওপরে দেখে না এবং চারপাশে কোথাও মাথা ঘুরায় না। বরং যখন সে তার অন্ধকার পথ বিদীর্ণ করে যায় তখনই সে কেবল অনুভব করে।
তার মাথার উপরে মানুষের পা আসা-যাওয়া করে। সেও অনুভব করে যে, যদি সে উপরে উঠতে চেষ্টা করে, তবে পোকা মাড়ানোর মতোই সেও পদদলিত হবে। সুতরাং পদশব্দ, নদীর স্রোত, ঢেউয়ের গর্জন, প্রতিমুহূর্ত, প্রতিঘণ্টা, প্রতিদিন সবকিছুই সে শুনছে আর তার পেছনে বয়ে চলেছে রক্তের স্রোত, যেন তাকে তা তাড়া করছে। যেন এটাই তার নিয়তি।
প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য মৃত্যু
এতগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, অথচ এখনো তুমি পায়ের নিচেই হে বামন কালো! পিতার দৃষ্টি থেকে ফুটে বেরিয়েছ নাকি মাটি তোমার মুখভর্তি করে তোমার চোখে বীজ বুনেছে? তোমার ও আলোর মাঝে বহু বছরের দূরত্ব হে ছোটো কালো! তোমার ও ভালোবাসা এবং মাংসের প্রেমময় দেয়ালের মাঝে বহু বছরের দূরত্ব! এই কি তোমার নিয়তি হে কৃঞ্চ বামন! অনন্তকাল কি ওই মাটির ভেতরই বেঁচে থাকবে, নিগূঢ় অন্ধকারে নিশ্বাস নেবে এবং এই অবারিত রক্তের স্রোতধারা অনুসরণ করবে? এই কি তোমার অদৃষ্ট যে, সমস্ত জীবন ধরে তুমি পদদলিত হবে। মানুষ তোমার কাঁধের ওপর দিয়ে তোমাকে দলিত করে যাবে। সারাজীবন এই মাটিই খাবে, মাটিতে শ্বাস নেবে আর এর রসই পান করবে?
ওহে বিচ্ছিরি বিকৃত দৈত্য! হে তোমার পিতার চোখ, যাকে নখ দিয়ে খুন করা হয়েছে। কেন মরো না তুমি? কেন এই বিপুল মাটির নিচে মুহূর্তের জন্য থামো না, যাতে তোমার বুকে ঝুলন্ত ওই শুভ্র আলোটি নিভে যাবে। তুমি কি জানো, তোমার জীবন এই ভীত, নৃশংস দৌড়ের উপর নির্ভর করে? জানো, তুমি থেমে গেলে রক্তের জোয়ার তোমাকে ডুবিয়ে শেষ করে দিত?
ওহে দুঃখী বামন কালো!... ওহে দুঃখী বামন কালো! কেন মরো না তুমি?
যা হোক, তবে ছোট্ট শিশুটি তার মস্তিষ্কে চেপে থাকা ওসব উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাগুলোকে পাত্তা দেয়নি। বরং উন্মত্তের মতো আপন সাধনা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং পেছনে রক্তনদীর সেই পৈশাচিক গর্জন অনুভব করছিল। যেখানে অন্ধের চতুরতা এবং পাথরের কঠোরতা দিয়ে আপন পথ খুঁজছে সে। সেই দীর্ঘ বছরগুলোর মাঝে দৃঢ়সংকল্প প্রস্থানে আপত্তি করলে তার নখগুলো লোহায় আঁচড় দিতে পারে। সুতরাং ধূসর আবেশ এক মুহূর্তের জন্যও এই জ্বলন্ত উৎসাহ থামাতে পারে না।
তার জন্মের বহু বৎসর পেরুনোর পরও কেউ তাকে টের পায়নি। ফলে তার কোনো নামও দেয়া হয়নি। এমনকি নাম বা উপাধিতে চেনার জন্য কেউ তাকে তার হিসাবেই রাখেনি। মোটকথা কখনো কেউ তার উপস্থিতিই অনুভব করেনি... সত্যিই? তবে একজন ছাড়া। অনেক বছর পূর্বে যে মৃত্যু তার পিতাকে মে মাসের বাঁকে তার নখ দিয়ে হত্যা করেছিলে, তখন তিনি জানতেন যে, কালো নবজাতকটি মাটির নিচে এখানেই কোথাও রয়েছে। সুতরাং বের হওয়ার পথ পদদলিত করার জন্য পা জড়ো করেছিল... এবং এর বেশি কিছু করতে সক্ষম হয়নি সে।
তুমি বড় হয়ে গেছ হে বামন কালো! তোমার বয়স চৌদ্দ হয়েছে। চৌদ্দটি মে তোমার ওপর গত হয়েছে। চৌদ্দটি বসন্ত লাগাতার রক্তস্রোত জলদান করেছে, অথচ পোকার মতো অতীতে কী খুঁজছ তুমি হে কালো বামন? কোন পরিত্রাণের আশা কর তুমি? কোথায় তোমার পথ শেষ হবে হে দুঃখী? কখনো কি শেষ করার কথা ভেবেছ? পায়ের কষ্ট দূর করতে তোমায় পদদলিত করে খোঁজা? কোন সমাপ্তি খুঁজছ তুমি? কোন সমাপ্তি? তোমার বুকের মাঝে কতদিন আর সাদা বাতিটি দুলতে থাকবে?
যুদ্ধের জন্য তুমি খুব ছোট। দশটি নখ এখনো বর্শার ফলার মতো উজ্জ্বল জ্বলজ্বল করছে আর তোমার কালো চামড়া দিয়ে রক্তের স্রোত শুকিয়ে ভোরের অপেক্ষা করছে।
শত্রুদের সাথে লড়াই করার জন্য তুমি খুব ছোট, হে পাগল।
ওহে! মে বসন্তের ওপরে তোমার মৃত পিতার চোখ।
ওহে চরণ স্তূপের নিচে বসবাসকারী বড় হও... বড় হও... কেন তুমি মৃত্যুর আগে প্রতিদ্ব›দ্বী হও না।
মরো... মরে যাও... মোমবাতির মতো তোমার বুকে ঝুলে থাকা সাদা বিন্দুটিকে নিভতে না দিয়ে তুমি তোমার ঘাম নিঃশেষ করে পেশি গলিয়ে ফেলেছ। কী বাকি আছে আর তোমার? অনেক বকছ? কথা বলছ? তোমার ঠোঁটদ্বয় তোমার দন্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করছ? সেই ঘাম থেকে রক্ত ঝরছে যা হাজার হাজার মহান মানুষ তৈরি করে। ওহে আঙুলের গিঁট! হে রূপবিকৃতি, হে শহীদের চোখ! প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আগে মোরো না... মোরো না।