
হুদহুদ পাখি। ছবি: সংগৃহীত
অক্টোবরের শুরু; ঘন বাদলের দিন বিদায় নিয়েছে। বৃষ্টিধোয়া আকাশটা ধূলিহীন, ঝকঝকে। পূর্বাচলের বিরাণ প্রান্তরে ভোরের হালকা কুয়াশা। ঘুঘু আর শালিকেরা সারি দিয়ে বসেছে বিদ্যুতের তারে। ওরা জানে কুয়াশার ভোরে রোদ পোহানোয় কী সুখ।
পূর্বাচলের জনহীন পথে আমরা হাঁটছি বিরল পাখির তালাশে। দেখি, বিদ্যুতের তারে বসে আছে এক হুদহুদ। সম্ভবত সে সদ্য এসেছে; শুকনো দিনে নিজ দেশে প্রত্যাগত একটি পাখি। অনেকেই এদের আখ্যা দিয়েছেন, শীতের অতিথি। আসলে বৃষ্টি শেষ হলেই পরিযায়ী পাখিরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করে, শীতের অপেক্ষা করে না।
পাখির দৃষ্টিতে এ দেশে মাত্র দুটি মৌসুম; ভেজা-মৌসুম আর শুকনো-মৌসুম। ছ’মাস ভেজা আর ছ’মাস শুকনো। বৈশাখ থেকে আশ্বিন ভেজা-মৌসুম এবং কার্তিক থেকে চৈত্র শুকনো-মৌসুম। এ দুই মৌসুমেরই পরিযায়ী পাখি আছে বাংলাদেশে। নিভৃতচারী শুমচা ও পাপিয়ারা শুকনো-মৌসুমে এ দেশ ছেড়ে যায় আহারের খোঁজে। আর যূঁথচর হাঁস ও সৈকত পাখিরা ভেজা-মৌসুমে দেশত্যাগ করে যায় প্রজননের তাগিদে।
হুদহুদ পাখিরা শুকনো-মৌসুমেই থাকে এ দেশে। ভেজা-মৌসুমে ওরা যায় উত্তরে; চীন, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ায় প্রজনন ভূমির সন্ধানে। তবে ভেজা-মৌসুমেও বাংলাদেশে আমরা দু-একটি হুদহুদের দেখা পাই। জানিনা বর্ষাকালেও এ হতভাগাগুলো কেন দেশ ছাড়ে না! প্রজননের তাগিদ নেই; না কি নিছক দেশপ্রেম!
বর্ষায় পূর্বাচলে আমরা কখনও দেশপ্রেমী কোনো হুদহুদ পাইনি। তাই বলতে পারি, বিদ্যুতের তারে বসা হুদহুদটি যোজন পাড়ি দেওয়া একপাখি। হিমালয় পেরিয়ে হয়তো আজই সে এখানে এসে হাজির হয়েছে। কোনো সীমান্তেই তাকে করোনা পরীক্ষা কিংবা কোয়ারেন্টাইন করতে হয়নি।

বহু যোজন পাড়ি দেওয়া এমনই এক হুদহুদ পাখি ভাবিত করেছিল পারস্যের এক সুফি কবিকে। এক হাজার বছর আগের কথা। হুদহুদ পাখিকে মুখ্য চরিত্র দিয়ে কবি ফরিদুদ্দীন আত্তার একটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন। গ্রন্থের নাম ‘মানতিকুৎতাইয়ির’, অর্থাৎ ‘পাখির সমাবেশ’।
কবি সুলভ সৃজনী শক্তি দিয়ে সুফি ফরিদুদ্দীন আত্তার পৃথিবীর সব পাখিকে ইরানের গহীন এক বনে একত্রিত করলেন। তারপর পাখির অজ্ঞাত সম্রাট ‘সিমুর্গ’ অন্বেষণের এক অভিনব অভিযানে তাদের পাঠালেন। সে অভিযানের গাইড হলো হুদহুদ পাখি।
‘মানতিকুৎতাইয়ির’ কাব্যের পাঁচ লাইনের এই ভাবানুবাদ পড়লে পাখির অনন্য সে সমাবেশের আবহ কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
প্রিয় হুদহুদ, তুমিই হবে গাইড মোদের:
তোমাতে আস্থা ছিল বাদশা সুলেমানের,
তুমি খবর দিলে তাই শেবা রাজ্যের রানি
সম্বন্ধে বাদশা অবগত হলো ব’লে জানি।
বাদশা জানে তব ভাষা, তুমি জানো তার মন
যা বলছিলাম, আমাদের মন বুঝতেও পূর্বাচলের হুদহুদ পাখিটির বিলম্ব হলো না। আমাদের মন চাইছিল হুদহুদ পাখির উড়ে চলার অপূর্ব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে। বিদ্যুতের তার ছেড়ে তখনই হুদহুদটি উড়ে নামল মাঠের ঘাসে। তার ডানার চোখ-ধাঁধানো জেব্রা-ডোরা দেখে আর ছবি তুলে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হলো।
শুধু ডানা দেখিয়েই ক্ষান্ত হলো না হুদহুদ। মাঠের ঘাস স্পর্শ করতে না করতেই পালকের বিশাল মুকুটটি সে তার মাথার ওপরে তুলে ধরল। নিঃসন্দেহে সে আমাদের মন বুঝেছিল। আমরা মুকুট তোলা হুদহুদের ছবি তোলার বিরল সুযোগ পেয়ে উচ্ছ¡সিত হলাম।
পালকের মুকুটটি হুদহুদ আজীবন চীনা-পাখার মতো ভাঁজ করে রাখে। কেবলমাত্র উড়ে এসে বসার মুহূর্তে সে তার দর্শনীয় মুকুটটি ক্ষণিকের জন্য তুলে ধরেই নামিয়ে ফেলে। তার মুকুট তোলা ছবি তাই মেলে মহাভাগ্যে।
হাজার হাজার বছর আগের মানুষের মনেও যে হুদহুদ দাগ কেটেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচুর প্রাচীন কেচ্ছা-কাহিনী পাওয়া যায় এ পাখিটি নিয়ে। মানুষের বসতির আশপাশে আসে এমন পাখির মধ্যে হুদহুদের মতো অমন চোখ-ধাঁধানো ডানা আর মুকুটপরা পাখি নেই বলেই হয়তো তার অত কদর ছিল।
পাঁচ হাজার বছর আগেও ব্যাবিলন ও মিসরের মানুষ যে হুদহুদ পাখিকে পবিত্র ও পূজনীয় গণ্য করত তার স্বাক্ষর তাদের শিলালিপিতেই পাওয়া যায়। তার অনেক পরে তোরাহ ও কোরআন এই দুটি পবিত্র কিতাবেও হুদহুদ নিয়ে দীর্ঘ কাহিনী রয়েছে।
পবিত্র কিতাব বলেছে, দীর্ঘকাল দরবারে অনুপস্থিত থাকায় হুদহুদ পাখির জন্য শাস্তি ঘোষণা করলেন বাদশা ও নবী সুলেমান (আ.)। তা শুনে হুদহুদ মোটেই দমে গেল না। কারণ, কয়েক বছরের পথ জাদুবলে পাড়ি দিয়ে কয়েক মাসে সে সুদূর শেবা রাজ্য ভ্রমণ করে এসেছে।
বাদশাকে হুদহুদ বলল, ‘আমি যা জানি আপনি তা জানেন না। কথা সত্য; হুদহুদের কাছে বাদশা প্রথম জানতে পারলেন সুদূর শেবা রাজ্যের সূর্য-উপাসক মানুষজন ও তাদের রানীর কথা। তারপর বাদশার পত্র নিয়ে হুদহুদ শেবা রাজ্যে চলে গেল এবং পত্রপাঠ রানী এসে হাজির হলেন বাদশার দরবারে।
আগের দিনের লোক ভালই জানতেন যে কথায় কথায় হুদহুদ পাখি এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়। সম্প্রতি আমরা জেনেছি যে ভেজা- মৌসুমে বাংলাদেশের হুদহুদ চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া যায়; এবং শুকনো-মৌসুমে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে।
পরিযায়নের এই পথে এদেশের হুদহুদ পাখিদের দু’বার হিমালয় পর্বত পার হতে হয়। পাখিগুলো কি খুঁজে খুঁজে হিমালয় পর্বতের সবচেয়ে নিচু জায়গা দিয়ে উড়ে যায়? মোটেই তা নয়। হুদহুদকে হিমালয়ের ছ’হাজার মিটার চ‚ড়া অতিক্রম করতেও দেখা গেছে।
পূর্বাচলে ঘাসের মাঠে যে হুদহুদ পাখিটি নীরবে হাঁটছে, সে সম্ভবত অতি সম্প্রতি হিমালয় পর্বত পার হয়েছে। হয়তো বিশ্রাম নিতে সে পুনাখায় দেচেনচোলিং প্রাসাদের মাঠে থেমেছিল এবং ঘটনাক্রমে ভুটানের ড্রাগনরাজার জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহ উৎসবটি দেখে এসেছে। বাদশা সুলেমান বেঁচে থাকলে সে হয়তো সবই তাঁকে খুলে বলত।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বাদশা সুলেমানের মতো আমরা পাখির ভাষা বুঝিনা। অবলীলাক্রমে হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে যাওয়ার কথাটা আমরা হুদহুদের মুখে শুনতে পারিনি; বইতে পড়েছি। এভারেস্ট শিখরে মানুষের প্রথম অভিযানে গিয়ে অভিযাত্রীরা ২১ হাজার ফুট উঁচুতে একটি হুদহুদ পাখি দেখে সে কথাটা লিখে রেখেছিলেন।
হুদহুদ পাখি কি কোনদিন বাদশা সুলেমান কিংবা পরবর্তী কোনো মরুভ‚মির বাদশাকে হিমালয় নামক এই চির তুষারের বিশাল জগতের কথা বলেছিল? কিংবা বলেছিল ছয় শতকের চীনে ত্যাং-রাজবংশের ব্যাভিচারী সম্রাজ্ঞী ঊ-জেতিয়ানের কথা? নিশ্চয়ই বলেনি। বলে থাকলে, শেবা-র রানীর মতো আমন্ত্রিত হয়ে চীন-সম্রাজ্ঞীও কি মধ্যপ্রাচ্য সফরে বেরিয়ে পড়তেন না?
পতনোন্মুখ রোম সাম্রাজ্যের পাশে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র জনপদের এক বাদশাকে দেখার আগ্রহ খুব বেশি না থাকলেও অদ্ভুত কাজে নেমে পরার একটা রোখ ছিল ঊ-জেতিয়ানের। পাখির সাথে কথা কয় এমন বাদশাকে দেখার একটা আগ্রহ সম্রাজ্ঞীর মনে
মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত বৈকি!

বাদশা সুলেমানকে ভুয়োদর্শী হুদহুদ পৃথিবীর কত সংবাদ, তথ্য আর তত্ত্বকথা পরিবেশন করেছিল তা আজ বলা কঠিন। তবে, আমরা নিশ্চিত যে হুদহুদ পরিবারের একটি নোংরা তথ্য সর্বজ্ঞবাদশা সুলেমান স্বয়ং কখনো জানতে পারেননি।
সে গোপন তথ্যটি হলো এই যে, স্ত্রী-হুদহুদের একটি অতিশয় নোংরা অভ্যাস আছে। না; ঊ-জেতিয়ানের মতো ব্যাভিচারে আগ্রহী নয় স্ত্রী-হুদহুদ। তার আচরণ অত্যন্ত নোংরা। অযাচিত কেউ তার তার ঘরের কাছে গেলেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন দিকটা গৃহদ্বারে এনে লেজ তুলে তাকে পায়ুপথ দেখায়।
নিসঙ্গ প্রদর্শন করাই স্ত্রী-হুদহুদের নোংরা আচরণের শেষ নয়, শুরু। এর পর সে আগন্তুকের গায়ে অবর্ণনীয় দুর্গন্ধের তরল পিচকিরি ছুঁড়তে শুরু করে। দুর্গন্ধময় তরল পদার্থ তৈরি করা ও ছুঁড়ে মারার জন্য স্ত্রী-হুদহুদের পাছায় বিশেষ গ্ল্যান্ড আছে।
ডিম দেওয়ার জন্য গাছের কোটরে বসতে শুরু করলেই স্ত্রী-হুদহুদের পিচকিরি-গ্ল্যান্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ডিম দেওয়া, ডিমে তা দেওয়া আর ছানা বড় হওয়ার পুরো সময়টা সে কোটরেই থাকে। পুরুষ-হুদহুদ বারবার এসে স্ত্রী ও ছানাদের আহার দিয়ে যায়।
জোড়ার পুরুষ-হুদহুদটি ছাড়া অন্য কেউ কোটরের কাছে গেলেই তার মুখ ভিজে যায় পুতিগন্ধময় তরল পদার্থে। স্ত্রী-হুদহুদের ছোঁড়া ফেইস-ওয়াসে পচা মাংসের মতো যে তীব্র গন্ধ থাকে তা কোনো প্রাণিই সহ্য করতে পারে না। দ্বিতীয় দফায় ফেইস-ওয়াস নিতে খুব কমই কেউ কোটরের কাছে যায়।
শত্রুর মুখে মল ছুঁড়ে মারতে হুদহুদের এই অসাধারণ ক্ষমতাটি প্রাণী জগতে অত্যন্ত বিরল; কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহ বয়স থকেই হুদহুদ-ছানারাও পিচকিরি ছুঁড়তে পারে। তখন কোটরের কাছে গেলে একসঙ্গে ফায়ার-ব্রিগেডের কয়টা হোস চালু হবে সে ভবিষ্যদ্বাণী কেউ করতে পারবে না।
ভোটাভুটির মাধ্যমে জনমত যাচাই করে ২০০৮ সালে একটি জাতীয় পাখি নির্বাচন করা হয়েছে ইসরায়েল রাষ্ট্রে। অপরের মুখে মল ছুঁড়ে মারার অভ্যাসটা জানা সত্ত্বেও, কিংবা সেই কারণেই, হুদহুদকে জাতীয় পাখির মর্যাদা দিয়েছে ইসরায়েল। তবে জাতীয় পাখির মর্যাদা পেয়ে হুদহুদ অবিলম্বে প্যালেস্টাইনবিরোধী হয়ে গেছে এমন দাবি করতে কেউ সাহস পায়নি আজও। হুদহুদের কোটরের কাছে গেলে সবার মুখেই পিচকিরি মারা হয়; সে ফিলিস্তিন হোক কি ইহুদি হোক।
সৌভাগ্যক্রমে কোটর ছেড়ে আসার পরপরই স্ত্রী-হুদহুদ আর ছানাদের পিচকিরি-গ্ল্যান্ড দুর্বল হয়ে যায়। তবে কোটর থেকে পচা মাংসের তীব্র গন্ধ সরে যেতে অনেকটা সময় লাগে। ইতিমধ্যে স্ত্রী-হুদহুদের দেহে নতুন পালক আসে। পুতিগন্ধময় অতীতের কথা ভুলে সে সগৌরবে ডানা মেলে ওড়াউড়ি শুরু করে।
হুদহুদের স্ত্রী, পুরুষ ও ছানারা প্রজনন ভ‚মির মায়া কাটিয়ে দ্রুত ভিন্ন ভিন্ন দিকে উড়াল দেয়; অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশেও গিয়ে হাজির হয়। যদিও প্রজনন মৌসুমে হুদহুদ বহুগামী নয়; আজীবন জোড়া বেঁধে চলাটা হুদহুদের ভবঘুরে জীবনে তেমন খাপ খায় না। অধিকাংশ হুদহুদ তাই একাকী ভ্রমণ করে।
সুদর্শন, চটপটে আর ভবঘুরে পাখি হুদহুদকে গাইড বানিয়ে একাদশ শতকে ইরানের বিখ্যাত নগর নিশাপুরের কাল্পনিক বনে কবি ফরিদুদ্দীন আত্তার পাখিদের সম্রাট সিমুর্গের তল্লাশে নামিয়েছিলেন। কবি বলেছেন, যদিও এক লক্ষ পাখি সমবেত হয়েছিল, একমাত্র হুদহুদের সাধ্য ছিল সেই কঠিন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার।
লক্ষ পাখিকে হুদহুদ একে একে সাতটি দুর্গম উপত্যকা পার হওয়ার অনন্য এক অভিযানে নিয়ে চলল। সাত উপত্যকার নামছিল অনুসন্ধান, সম্মোহন, প্রজ্ঞা, একাকীত্ব, মিলন, বিভ্রান্তি ও শূন্যতা। উপত্যকার নামেই ইঙ্গিত রয়েছে সেখানে পাখিদের কী কী অর্জন হতে পারে।
উপত্যকাগুলো পার হওয়া মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। নানা অক্ষমতা ও আপত্তি জানিয়ে অনেক পাখি অভিযান থেকে ঝরে পড়তে থাকল। বিদগ্ধ হুদহুদ একা সব পাখির আপত্তি খণ্ডন করে চলল। সেই সঙ্গে তার প্রচেষ্টা ছিল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার দিক নির্দেশনা দেওয়া আর পাখিদের ক্ষমতায়ন করা। হুদহুদের নেতৃত্বে অবশেষে মাত্র ত্রিশটি পাখি সর্বশেষ উপত্যকায় এলো; যেখানে পাখি-সম্রাট সিমুর্গের সাক্ষাৎ মেলার কথা। এ উপত্যকার নাম ‘শূন্যতা’ এবং দেখা গেল উপত্যকাটি আসলেই শূন্য; সিমুর্গ নামের কোনো পাখি সেখানে নেই।
হুদহুদ বলল, ‘গভীর মনযোগ দিয়ে যে যা খোঁজে সে নিজেই তা হয়ে যায়।’ পাখি-সম্রাটকে যে প্রাণপণ খুঁজেছে সে নিজেই পাখি-সম্রাট হয়েছে। সিমুর্গের সন্ধানে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকা এই ত্রিশটি পাখিই হলো পাখি-সম্রাট সিমুর্গ। ফার্সি ভাষায় ‘সি’ বললে বোঝায় ৩০ এবং ‘মুর্গ’ বললে বোঝায় পাখি। দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন কবি শুরুতেই পাখি-সম্রাটের নাম দিয়েছিলেন সিমুর্গ।
সিমুর্গ অনুসন্ধান শেষে ‘শূন্যতা’ উপত্যকায় ত্রিশ পাখিকে বিদায় জানিয়ে গাইড-হুদহুদ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এই রূপক কাব্যটি প্রকাশ করার পর কবিও কিছু দিনের জন্য নিশাপুর থেকে নিরুদ্দেশ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঈশ্বরের একত্বে আঘাত হানার অভিযোগ উঠেছিল।
শুকনো-মৌসুমের শুরুতেই আমরা দুই পাখি-সন্ধানী মহাভাগ্যে পূর্বাচলে এই হুদহুদ পাখিটির সাক্ষাৎ পেয়েছি। শায়খ ফরিদুদ্দীন আত্তারের সাতটি আধ্যাত্মিক উপত্যকা অতিক্রম করুক কি না করুক এ পাখি উত্তরের তাইগা অঞ্চল থেকে উড়াল দিয়ে হিমালয় অতিক্রম করে তবে এখানে আসতে পেরেছে।
হুদহুদ পাখির এই ভ্রমণটি যে কম চালেঞ্জিং কিংবা কম ঘটনাবহুল, তা বলা মুশকিল। কৈশোরে তাইগা অঞ্চল ত্যাগ করে হয়তো সে একাকী উড়াল দিয়েছিল এবং দীর্ঘ যাত্রায় সে নিজেই ছিল তার গাইড। আকাশ পথে চলার সময় তার মনে ছিল শিকরে, শাহিন ও অন্যান্য পাখি-শিকারি পাখির আক্রমণের ভয়।
দীর্ঘ পরিযায়ণকালে হুদহুদ পাখিটি যে সব গাছে নিশিযাপন করেছে তার ডালে খাটাস, বনবিড়াল আর হুতোম প্যাঁচার মতো শিকারিরাও ওঁৎ পেতে ছিল। যাত্রাপথে আমাদের এই হুদহুদ পাখিটি সিমুর্গ অনুসন্ধান না করলেও প্রতিদিন আহারের খোঁজে সে নানা রকমের ঘাতক উপত্যকায় নেমেছে।
পূর্বাচল এই হুদহুদটির শেষ উপত্যকা। শুকনো-মৌসুমটা সম্ভবত সে পূর্বাচলের ঘাসের প্রান্তরে কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আশা করি পূর্বাচল পাখিটির জন্য শায়খ ফরিদুদ্দীন আত্তারের ‘শূন্যতা’ উপত্যকায় পরিণত হবে না।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য পাখিবিদ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অগ্রদূত