
প্রতীকী ছবি
শাহজাহান তালুকদার, তার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। ছেলের পড়াশোনায় মন নেই। সারাদিন মোবাইল ফোন টেপাটিপি করে। তাই আজ সঙ্গে করে তার আড়তে নিয়ে এসেছেন। অংক বই আর খাতা কলম নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন। বসে বসে বাবার চোখের সামনে অংক কর। তিনি বেছে বেছে বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অংকটাই করতে দিয়েছেন। ছোটবেলায় এই অংকটা তার মাথা নষ্ট করে দিত, দেখি ছেলে পারে কিনা। ছেলে নাইনে পড়ে।
- বাবা?
- উ
- ও বাবা?
- আবার কি হলো? অংক কর
- করতেছিতো, আচ্ছা বাবা এগুলো কি? ছেলে আড়তের শত খানেক সিল করা ড্রামের দিকে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
- তেল
- কি তেল বাবা?
- সোয়াবিন তেল
- বাবা তুমি এগুলো মজুদ করেছ না? বাবা এবার রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন ছেলের দিকে। এই ছেলেটার কেমন যেন ভয়-ডর নেই, মায়ের মতো হয়েছে। মাছের চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতি পর্যন্ত পড়ে না।
- বললাম না, কথা না বলে অংকটা শেষ কর!
- বাবা তুমি মজুদদার না? তেল মজুদ করেছ... বাবা এবার হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। ‘এসব কথা কোথায় শিখেছিস হারামজাদা?’
- কেন ফেসবুকে এসব নিয়েইতো আলোচনা হয়। মানুষ তেল পাচ্ছে না। মজুদদাররা সব তেল মজুদ করে রেখেছে, শুধু তেল না চাল, ডাল, পেঁয়াজ সব... ক্লাস নাইনে পড়ুয়া ছেলে মোটামোটি একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল। শাহজাহান সাহেবের ইচ্ছে হলো হুঙ্কার দিয়ে ছেলের গলাটা চেপে ধরেন; কিন্তু না এভাবে হবে না। তিনি নিজেকে সামলালেন। নিজেকে নিজে বললেন ‘শাহজাহান শান্ত হও, ছেলেকে যুক্তি দিয়ে বোঝাও... তুমি ভুলে গেছ, বিশ^বিদ্যালয় জীবনে যুক্তি-তর্কে তুমি এক সময় তুখোড় ছিলে।’ শাহজাহান তালুকদার লম্বা করে শ্বাস নিলেন তারপর ছেলের দিকে তাকালেন।
- বাবা, ব্যাপারটা এরকম না। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে প্রতিটা দুর্ভিক্ষ আর মহামারির পরে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়... এটাই নিয়ম। অর্থনীতির...
- কিন্তু তুমি যে তেল স্টক করেছ এটাতো ঠিক? আর বাইরে মানুষ তেল পাচ্ছে না। ট্রাকের পিছনে দৌড়াচ্ছে। আমি খবরে দেখেছি।
- আমি তেলের ব্যবসায়ী। আমার আড়তে তেল মজুদ থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক।
- আমি গুনে দেখেছি চল্লিশটি ড্রাম আছে।
- চল্লিশটি নাকি? থাকার কথা এক চল্লিশটি।
- বাবা এখন যদি আলীবাবা আসে, চল্লিশ চোর নিয়ে। শাহজাহান তালুকদার টের পেলেন তার মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। ছেলেটা তার সঙ্গে ইয়ার্কি শুরু করেছে। ওকে আড়তে আনাটা বিরাট ভুল হয়েছে। হঠাৎ শাহজাহান তালুকদারের গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল। মুখের ভিতর টক টক লাগছে। মাথাটাও কেমন চক্কর দিচ্ছে! ডায়াবেটিসটা বাড়ল নাকি। আজ ভুল করে ডায়াবেটিসের ওষুধ না খেয়েই বের হয়েছেন।
- বাবা? ছেলে চেঁচায়, ‘অংকটা মিলছে না। বানরটা চার ফুট উঠে পিছলে নামে তিন ফুট। বাবা বাঁশটায় তেল দিল কে?’ তাইতো তেল দিল কে? আর বানরের ওই বাঁশ বেয়েই বা উঠতে হবে কেন? শাহজাহান তালুকদার হঠাৎ দেখেন তার সামনে জমকালো জরির পোশাক পরে মাথায় সুলতান সুলেমানের মতো মুকুট, কে একজন দাঁড়িয়ে কোমরে তলোয়ার ঝুলছে। সঙ্গে আবার একজন, তার পোশাকও বেশ জমকালো। সত্যি সত্যি আলী বাবা চলে এলো নাকি? তাহলে বাকি ঊনচল্লিশ চোর কোথায়!
- আপনি কে?
- আমি সম্রাট শাহজাহান... তার মানে ডায়াবেটিস বেড়েছে; নির্ঘাৎ হাইপো হয়েছে, হাইপো হলে অনেক সময় নাকি এরকম হ্যালোসিনেশন হয় কারো কারো। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন একটা চকলেট থাকার কথা। ওটা মুখে দিয়ে চুষলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, শরীরে এখন জরুরি ভিত্তিতে সুগার দরকার। তিনি এইরকম পরিস্থিতির জন্য সবসময় পকেটে একটি দুটি চকলেট রাখেন; কিন্তু সেকি পকেট ফাঁকা কোনো চকলেট নেই। ছেলেকে বলবেন নাকি দৌড়ে একটা চকলেট নিয়ে আসতে। তাকিয়ে দেখেন ছেলে নেই। অংকের বই আর খাতাটা পরে আছে, হারামজাদাটা গেল কই!
- আমি সম্রাট শাহজাহান... আর এ আমার শাহজাদা।
- আর আমি তেলের পাইকার শাহজাহান তালুকদার... আর এ আমার হারামজাদা। তিনি পাশে বসা ছেলেকে দেখালেন, এখন দেখি সে আবার বসে আছে নিবিষ্ট মনে অংক কষছে। সে কি ইনাদের দেখতে পাচ্ছে না।
ঠিক তখনই তিনি বাম পকেটে চকলেটটা খুঁজে পেলেন। তার মনে পড়ল ছাত্রজীবনে কিছুদিন বাম রাজনীতি করেছেন বলে সব ধরনের বামের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল, রিকশা ডানে মোড় নিলে তিনি রেগে উঠতেন পর্যন্ত। তিনি আর দেরী করলেন না চট করে মুখে দিলেন চকলেটটা। মুহূর্তে সব ঠিক হয়ে গেল যেন। তাকিয়ে দেখেন তার সামনে এখন আর সম্রাট শাহজাহান আর তার শাহজাদা দাঁড়িয়ে নেই। তবে আরো কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে, সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশও দেখা যাচ্ছে।
- আপনারা কারা?
- আমি মাজিস্ট্রেট আলী আহম্মদ। আপনার গোডাউনে প্রচুর তেল পাওয়া গেছে। দেশের এই ক্রাইসিস মোমেন্টে তেল স্টক করার জন্য আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
পাশ থেকে ছেলে হঠাৎ ফিস ফিস করল ‘বাবা অংকটা এবার মিলেছে!’