
গল্প। প্রতীকী ছবি
শীনা ওয়েকফিল্ড কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘রঁদেভু ইন ভায়াজনিকি’ গল্পটি সোভিয়েত লিটারেচার পত্রিকার জুন, ১৯৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ভ্লাদিমির সোলুখির জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ সালে, ভ্লাদিমির অঞ্চলে। কবি এবং গদ্যকার। রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন। গোর্কি লিটারেরি ইনস্টিটিউটের স্নাতক। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন। কবিতা এবং সমসাময়িক গ্রামীণ জীবনের ওপর আধারিত গল্পের একাধিক সংকলনের প্রণেতা।
সেই ছোট্ট শহরটার নাম আমি কয়েকবার জোরে জোরে আওড়ালাম, ভায়াজনিকি, ভায়াজনিকি, ভায়াজনিকি। অদ্ভুত ব্যাপার! আমার হৃদয় অশান্ত হলো না; কিন্তু সামান্য শ্বাসরোধী শীতলতা বা সংকোচন অনুভব করলাম সেখানে। অর্থাৎ ওই শব্দটা, ভায়াজনিকি, শুনলে অন্তত একটা তারেও ক্ষীণ ঝঙ্কার ওঠে, হাতে পারে সেটা সর্বশেষ, আর পুরোপুরি মরচে-ধরা একটা তার।
হোটেলের বন্ধ ঘরে দুটি আলাদা বিছানায় শুয়ে আমি আর আমার বন্ধু ভাবছিলাম কীভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মস্কো পৌঁছনো যায়, ট্রেন ধরব, না রাস্তায় নেমে একটা চলন্ত গাড়ি দাঁড় করাব। পরিবহন মাধ্যমের বিষয়ে মনস্থির করতে বেশি দেরি আমাদের হবার কথা ছিল না; কিন্তু অলসতাবশত আমরা সাহস করে গরমের মধ্যে বেরোতে পারছিলাম না। তাই শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম।
আমার বন্ধু একজন শিল্পী। ঘোরাঘুরি করতে করতে আমরা দু’জনে ক্লায়াজমার উঁচু পাড়ে এই ছোট শহরটায় এসে পৌঁছেছি। শহরটা প্রধানত সবুজ চেরি বাগিচা দিয়ে ঘেরা।
আমি আগে ভায়াজনিকিতে আসিনি। যদিও আমি জায়গাটার নাম শুনেছি কুড়ি বছর আগে। তখন আমার বয়স ষোল। নামটা শুনে তখন আমার মনে কোনো ছবির উদয় হয়নি, চেরির বাগান, বা জমজমাট বাজার যার দোকানগুলো মাশরুম, বুনো বেরি আর কাঠের রঙিন চামচ দিয়ে ঠাসা, বা শহরের প্রধান চত্বরটা যার প্রান্তে ধুলো ভরা গাড়িগুলো ভিড় করে আছে, বা আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো যেগুলো খাড়া উঠে গিয়ে তারপর পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা নেমে গেছে, বা দু’দিকের চরের মধ্যে দিয়ে প্রবহমান ক্লায়াজমার ওপরে প্রশস্ত দৃশ্য ক্লায়াজমা পেরিয়ে ঝাপসা দূরত্বে পাইন অরণ্য।
এই এতশত আমি দেখেছি মাত্র গত তিন দিনে। তখন, কুড়ি বছর আগে, শহরটা আমার মনে কোনো ছবি তৈরি করেনি; কিন্তু আমি শব্দটা জানতাম আর আমি সেই মেয়েটিকে চিনতাম। আমি তার মিষ্টি সুরেলা নামটা জানতাম আর তার বাড়ি ছিল ভায়াজনিকিতে। যখনই কেউ ভায়াজনিকির উল্লেখ করত আমার মনে হতো সবাই যেন মাথা ঘুরিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন-বা তারা জানে যে আমি দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই সেই মেয়েটির কথা ভাবি।
না, ‘ভাবি’ শব্দটা সঠিক নয়। তাহলে দৈনিক চব্বিশ ঘণ্টা ধরে আমি কী করতাম, কী? শুধু তার জন্য বাঁচতাম? তার জন্য নিঃশ্বাস নিতাম? মন খারাপ করতাম? যন্ত্রণাদগ্ধ হতাম? কষ্ট পেতাম? নিজের ওপর অত্যাচার করতাম? আর কোন কোন শব্দ আছে? সবচেয়ে সঠিক, সবচেয়ে স্বাভাবিক শব্দটিতে ফিরে যাই তাহলে, আমার মনে হত যেন-বা সকলে জেনে ফেলবে আমি তাকে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই ভালোবাসি।
হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে, আমি তার জন্য সিগারেট ফোঁকা শুরু করেছিলাম, তার জন্য মদ খাওয়া শুরু করেছিলাম, তার জন্য তাস খেলা শুরু করেছিলাম আর তার জন্য কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। মনে হয় মানুষের প্রধান দোষগুলো সবই আমি এখানে লিপিবদ্ধ করলাম; কিন্তু তার প্রতি আমার তরুণ ভালোবাসার চেয়ে উজ্জ্বলতর আর শুদ্ধতর ভালোবাসা আর হয় না।
রোমিও, যাই হোক না কেন, তার জুলিয়েটকে চুমু খেয়েছিল, স্পর্শ করেছিল, আর লার্ক গান গেয়ে ওঠার সময় তারা ছিল একে অন্যের বাহুডোরে। সে যদি শুধু আমার কাছে এসে আমাকে চুমু খেত, অথবা আমি তাকে! হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমার প্রথম চুম্বনের কথা বলছি। সেই চুমুর কথা বলছি না, ধরুন যেটা ইম কোনো এক ছুটির দিন সন্ধ্যেবেলা নাদিউশা বলডোভার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে ছিনিয়ে নিয়েছিল, যার অর্ধেকটা সিরিয়াস, অর্ধেকটা মজা। হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে সে আমার পিঠের ডানা দুটির মধ্যিখানে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় মেরে আমাকে সরিয়ে দিয়েছিল। সেই চুমুর কথা বলছি না।
‘প্রথম চুমু’ বলতে যা বোঝায়, তার কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমার জীবন বর্ণময়, এবং আমি তা আনন্দে কাটিয়েছি। সে জীবনে আছে ট্রেনের ঝমঝম আর নিঃস্তব্ধ পথ, আছে নীল অ্যাডিয়াটিক সমুদ্র, সমরখন্দের ধ্বংসাবশেষ, আছে সংগীত আর আট গ্যালারি, মাছ ধরা আর পাহাড়ে চড়া, আছে গলন্ত তুষারের ফিসফিস আর শরৎকালের পাতাঝরার নীরবতা, আছে আমার ডেস্কে বসে বসে নিদ্রাহারা রাত কাটানো আর সাফল্যের আনন্দ, আছে মহিলার প্রেম আর আমার সন্তানের অর্থহীন বকবক... না, পিছনপানে তাকিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আমি আমার মৃত্যুশয্যাতে শুয়েও একজন চপলমতি মেয়ের একটি চুমুর বিনিময়ে আমার গোটা জীবনটা দিতে পারব না, কিন্তু আমাকে যদি বেছে নিতে তখন বলা হতো?
আমার ‘প্রথম চুমু’ কখনোই ঘটেনি। আমাদের সবারই বয়স তখন ষোল, তারও তাই। সে কি টেকনিক্যাল স্কুলের সব মেয়েদের মধ্যে সুন্দরিতমা ছিল? মনে হয়। বেশি সাহসী এবং আমার মতো গাইয়ার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। সিনিয়র ছেলেরা ওকে সবসময় ঘিরে রাখত।
গোপন কথাটি ফাঁস না করার চেষ্টা করতাম আমি, কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সবাই জেনে ফেলল যে আমি, গোগ (অবধারিতক্রমে যে নামে আমার সহপাঠীরা ডাকত আমাকে), ওই মেয়েটিকে নীরবে নিবেদিত চিত্তে ভালোবাসে।
প্রথম প্রথম তার বন্ধুরা আমার দিকে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকাত, তারপর তাকত বিস্ময়ের দৃষ্টিতে, আর শেষমেশ, থার্ড ইয়ারের শেষ দিকে, অর্থাৎ কোর্সটার শেষ দিকে, ঈর্ষা এবং বিষণ্নতা ভরা চোখে। আমার এখন মনে হয় যে এইরকম নাছোড়বান্দা, তুলনারহিত প্রেম তাদের কপালে নেই বলে তাদের ওইরকম ঈর্ষা ও বিষণ্নতা।
তার বন্ধুরা জানত কি-না, তা সেই অবশ্যই জানত। আমরা একই ইয়ারের ছাত্র ছিলাম। আর প্রত্যেক দিন টানা কয়েক ঘণ্টা আমাদের সাক্ষাৎ হতো। এই তিন বছরে আমাদের কথা বলা, পাঠ্যবই বা আঁকার পেন বা কোনো একটা স্কেচ চেয়ে নেয়া, হোম ওয়ার্কের কোনো প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে আটকালে পরামর্শ বা সাহায্য নেওয়া ইত্যাদি ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু আমরা কখনো একে অন্যকে একাকী পাইনি, এক মিনিটের জন্যও নয়। অতএব, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হচ্ছি যে, হয় সে আমার সঙ্গে একা থেকে যেতে চায়নি, নয় সে আমার সঙ্গে একা হতে ভয় পেত। না, পরিষ্কার কথা, সে আমার প্রেমে পড়েনি, যদিও আমার মনে পড়ছে পাঠক্রমের শেষ দিকে বরফ বোধহয় গলেছিল এবং আমি তার মধ্যে এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করেছিলাম। সম্ভবত তা হলো দয়া, নতুবা তার বীর প্রেমপ্রার্থীর অনমনীয় বিশ্বস্ততার প্রতি কৃতজ্ঞতা। সংকোচন অনুভব করলাম, যেন-বা ওই শব্দটা, ভায়াজনিকি, শুনলে অন্তত একটা তারেও মৃদু ঝঙ্কার শোনা যায়, হতে পারে সেটা সর্বশেষ, পুরোপুরি মরচে-ধরা একটা তার।
মাথার পেছনে হাত দিয়ে, পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে রোমশ পা দুটি খাটের লোহার ফুটরেস্টের ওপর তুলে আমার বন্ধু শুয়েছিল।
আমি তাকে বললাম, শোন, একদিন পরে গেলে কেমন হয়?
কী কারণে?
একটা সন্ধ্যেবেলা আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। সে এসেছিল হোস্টেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে (সে থাকত কার্ল মার্কস স্ট্রিটে তার মাসির বাড়িতে)। আমি ওর বন্ধুদের সঙ্গে তাদের ঘরে বসেছিলাম। আমি খেয়াল করিনি কখন যেন ধীরে ধীরে রায়া ফালালেইয়েভনা, জোয়া পোস্তনোভা, টোনিয়া মিরোনোভা আর নিনা টেপলখিনা সবাই একে একে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আমরা বসেছিলাম একটা টেবিলে, যার ওপর ছিল একটা বিশাল ড্রয়িং বোর্ড, তাতে একটা স্কেচ, পিন দিয়ে আঁটা। ড্রয়িং বোর্ড আর স্কেচসহ টেবিলটা ছিল আমাদের মাঝখানে। মুখোমুখি বসে আমরা কথা বলেছিলাম। তিন বছরে প্রথমবার। যেনÑবা বসন্তকে বন্দি করে রেখেছিল তুষার আর তারপর হঠাৎ একদিন সকালে দক্ষিণ দিক থেকে এক দমক হাওয়া, জলীয় বাষ্প আর উষ্ণ বর্ষণ বয়ে নিয়ে এসে গাছপালার বরফ-মোড় ডালপালাগুলোকে আর মাটিকে ধ্ইুয়ে দিল। আর দু’দিন মাত্র, তারপরেই ফল ফুটবে।
ওর গাল দুটি উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল, ওর চোখ, ওর চোখ উষ্ণ আর উজ্জ্বল। আমার কথা বলতে পারি, সেই মুহূর্তে আমার অবস্থার কথা আমার মনে নেই। না, না, আমার আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলিনি, যা মনে এসেছে তাই নিয়েই বলেছি, আমরা আমাদের শৈশবের নানা কথা স্মরণ করছিলাম, সে তার শৈশবের, আমি আমার। কে কোন ফুল পছন্দ করত, কে ভালোবাসত বৃষ্টি, কে ভালোবাসত শীত। এইসব নিয়ে কথা বলেছিলাম। যা দেখালাম, সে ভালোবাসত লিলি, যেগুলো উপত্যকায় ফোটে।
তিন বছরে দুটি মাত্র ঘণ্টা এটা ওটা নিয়ে কথা বলা খুব বেশি কিছু নয়। উষ্ণ বারিপাত ঘটে গেছে, কিন্তু ফুলগুলো কোনোদিনই ফোটেনি, কারণ দু-এক দিনের মধ্যেই আমাদের গায়ে চাপল আর্মির ওভারকোট, ১৯৪২ সালে যেসব ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিল, তারা সবাই ভøাদিমির থেকে ট্রেনে চেপে বেরিয়ে গেল।
আমরা পড়াশোনা করেছিলাম ভøাদিমিরে, কিন্তু সেই মেয়ের বাড়ি ছিল ভায়াজনিকিতে। নামটা তার সঙ্গে যুক্ত। আমি তাই অবাক হয়ে গেলাম যখন শব্দটা পরপর তিনবার উচ্চারণ করাতেও আমার হৃদয় শান্তভাবে স্পন্দিত হয়ে চলল, যদিও মধুর এক শৈত্য সামান্য পরিমাণে অনুভব করলাম সেখানে, কিংবা তুমি আরেকটা স্কেচ করতে পারবে, এই ধরো পাহাড়ের ওপর থেকে। ডালপালার বেড়া একটা, বা একটা উঠোন, বা একটা বুড়ো গাছ। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার মনে পড়ল আমার এক বন্ধু এককালে এখানে ভায়াজনিকিতে থাকত। হয়তো আমি তাকে খুঁজে বার করতে পারব।
ছোট্ট শহরতলি ইয়ার্সসেভোতে যেতে হবে আমাকে। আমার মনে পড়ল কুড়ি বছর আগে আমাদের কথোপকথনে ইয়ার্তসেভো উল্লিখিত হয়েছিল, নইলে আর আমি জায়গাটার সম্পর্কে জানলাম কেমন করে?
মূল রাসায়, কাস্ট আয়রন দিয়ে তৈরি নিচু একটা রেলিংয়ের কাছে কয়েকটা পোস্ট ছিল যেগুলোর গায়ে লাল রঙের লোহার প্লেট লাগানো। বাসগুলো এইখানে থামে। লোকজন বসে বসে অপেক্ষা করছে যেন-বা কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে নয়, কিন্তু সাধের বাসটি এসে গেলে কোনো পোস্টে ছুটে গিয়ে কার পিছনে লাইনটা দিতে হবে সেটা প্রত্যেকে জানে।
বাসে বেজায় ভিড়। আমরা কোথায় যাচ্ছি আর কোন কোন রাস্তাঘাট বাড়িঘর পেরিয়ে যাচ্ছি, জানালা দিয়ে সেসব দেখা সম্ভব হলো না। আমি শুধু এটুকু বুঝলাম আমরা ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছি, মাঝে মাঝে তীব্র বাঁক নিয়ে।
কন্ডাক্টর হাঁকলো, ‘ইয়ার্তসেভো।
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি চড়া আবেগে ভাসছি। বলা বাহুল্য, সে এখনো ভায়াজনিকিতে থাকে বলে একেবারেই মনে হয় না। কুড়ি বছরে অনেক কিছুই ঘটে থাকতে পারে; কিন্তু আমি অন্তত তার জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে পারব হয়তো ওর মাকে দেখব, ওর ঘরটা দেখব।
প্রথমে অবশ্য আমি শহরতলির ওপর আড়াআড়ি হেঁটে গিয়ে গিরি খাতের ধারে পৌঁছলাম। (পরে দেখলাম ওখানকার স্থানীয় লোক জায়গাটাকে বলে দিক্রাউন।) আর কিছুক্ষণ সেখানে বসে বসে আমার নিচে ধোঁয়ার মেঘের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজে ভরা বাগিচাগুলো, বাগিচাগুলোর ওপারে ক্লায়াজমার আঁকাবাঁকা ফিতে, আর তারও ওপারে চরের এখানে ওখানে আয়নার মতো দেখতে লম্বা লম্বা হ্রদের টুকরোগুলো দেখতে লাগলাম।
সে কি কখনো এখানে হেঁটেছে? কখনো এসেছে সে এখানে একা একা? নাকি সে নাচতে বেশি গেছে? নাকি সে নাচতে বেশি গেছে? আমার তাতে কী?
ইয়ার্তসেভোতে একটা পোস্ট অফিস।
আপনি হয়তো আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন। আমি ওক্সানা সের্গেইয়েভনা পোতাপেঙ্কোকে খুঁজছি। তার মায়ের নামও পেতোপেঙ্কো।
তাতিয়ানা পেত্রোভনা?
মনে হয়। এটা তো পোল্টাভার মতো বড়ো শহর নয়, ইয়ার্তসেভোতে বেশি পোতাপেঙ্কো থাকবে বলে মনে হয় না।
ওরা এখানে থাকেন, কিন্তু সবার ঠিকানা তো আমার মনে রাখা সম্ভব নয়। পোস্টম্যান বলে দেবে।
কাউন্টারের পিছন থেকে অল্পবয়সী মেয়েরা কৌত‚হলী মুখ বাড়িয়ে দিল। ওরা নিশ্চিত বুঝেছে এ কোনো সাধারণ অনুসন্ধান নয়, এর পিছনে হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপার আছে। একজন মহিলা পোস্টম্যান সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পোতাপেঙ্কোদের বাড়ির রাস্তা দেখাতে রাজি হয়ে গেলেন।
ওরা এইখানে থাকেন; কিন্তু বাড়িতে কেউ আছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। উনি অবসর নিয়ে ওর বেশিরভাগ সময়টাই নাতনির দেখাশোনা করবার জন্য মেয়ের বাড়িতে থাকেন।
ওর মেয়ে কোথায় থাকে?
কোথায় থাকে মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন? ডেভিডকোভোতে, এই লাইনে ষোলো ভার্স্টের মতো দূরের একটা স্টেশন। ওঁর জামাই ওখানে একজন ইঞ্জিনিয়ার। ওক্সানা আর তার মেয়ে স্বেতলানা ওখানে আছে। আর ওই বৃদ্ধা তাঁর প্রায় পুরো সময়টাই ওখানে কাটান। যখনই কড়া নাড়ি এই দরজাটা দেখি বন্ধ।
তার নতুন পদবিটি কী?
ওক্সানা সের্গেইয়েভনা সুদাকোভা।
আমার আশা ছিল আমি হয়তো তার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎটা এড়িয়ে যেতে পারব। আমার এটার কোনো দরকার নেই, হলেই বা সে ইয়াশা সুদাকোভা, আমার যা মনে পড়ছে, যার সঙ্গে আমি মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার তাস পেটাতাম। একবার সে হেরে গিয়ে তাসগুলো ছুড়ে ফেলে বিজ্ঞজনের মতো মন্তব্য করবার ভঙ্গিতে বলল, তাসে তুমি লাকি ছোকরা, তোমার জন্য আমার দুঃখ হয়।
যাই হোক, ঘটনা হলো, আমরা ছিলাম অপরিচিত। রাস্তায় পাশ কাটিয়ে গেলেও আমরা পরস্পরকে চিনতে পারতাম না। এখন আমাদের কথাবার্তা বলতে হবে। আমি শুধু আশা করতে পারি সে কর্মস্থলে থাকবে।
দেখা গেল ডেভিডকোভো হলো সেই ধরনের শহর যেখানে ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে প্রথম যে ব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় সে হল ইয়াশা, পুরো নাম ইয়াকোভ ইয়াকোভলেভিচ সুদাকোভা।
ইয়াকোভ এমনভাবে হ্যালো বলল যেন আমার গতকাল একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করেছি আর এখন খোঁয়াড়ি কাটাবার জন্য আবার ড্রিঙ্ক করব বলে সাক্ষাৎ করছি। ওক্সানা তো নেই, সকালে ভায়াজনিকি গেছে। ঠিক আছে চলে আসো। দু’জনে বসে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করি।
আমরা এমন একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম যার দু’ধারে মনে হয় বাগান ছাড়া আর কিছু ছিল না। কথা খুব একটা বলেছিলাম না আমরা। তুমি তো পত্রপত্রিকায় লেখো। না? এই সেদিন ওক্সানা তোমার একটা কবিতা কোথেকে কেটে রেখে দিল। লুকিয়ে রেখেছে কোথাও। বলল, গোগার লেখা।
হ্যাঁ, আমি লিখি।
বাড়ির ভিতরে গিয়েও আমাদের বলার মতো কথা বিশেষ ছিল না। ওরা থাকে বড়-সড় একটা গ্রাম্য ধরনের কটেজে।
এই হলো আমাদের ফটো অ্যালবাম। এইটা সেই টেকনিক্যাল স্কুলের। দেখেছ, এইখানে একটি তোমার ছবি আছে। এইটা রোমানিয়ার, আমাদের বিয়ের ঠিক পরেই। আমি তখন ওখানে অফিসার হিসেবে কাজ করি। এইটা সোচিতে আর এই ফোটোগুলো আনাড়ি হাতে তোলা। একটা ফোটোতে দেখা গেল সাদা কোঁচকানো চাদরের মধ্যে ওক্সানা লিনেনের একটা ব্রা পরে বিছানায় বসে আছে।
কন্ট্রাস্টটা বড্ড বেশি, আলো কম। দ্যাখো, শুধু কালো আর সাদা, মাঝামাঝি কোনো শেড নেই।
তাহলে তুমিও ক্যামেরা নিয়ে এটা ওটা করো!
ওই যখন মনে হয়। এইটা ভায়াজনিকিতে, দি ক্রাউন-এ। জানো তো, গিরি খাতটা। ওইটা এখানে, ডেভিডকোভোতে।
টেকনিক্যাল স্কুলের ছবিগুলো একবার দেখি তো, ছেলেগুলোকে মনে করতে পারি কিনা দেখি। এদের কারোর সম্পর্কের তুমি কিছু জানো?
প্রায় সবাই প্রাণ হারিয়েছিল। তখন আমাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মনে আছে? ১৯৪২-এর শরৎকালে। সোজা যুদ্ধে। এক মুঠো খড় যেন ফেলে দেওয়া হলো আগুনে। তুমি বাঁচলে কী করে?
জানি না। আমি পিছনে ছিলাম, যুদ্ধে নয়। কপাল জোরে বেঁচে গেছি। তুমি?
বেঁচে গেছি। আমাদের সবাই তো মরেনি। আচ্ছা, কেউ যখন নেই রাস্তা দিয়ে খানিকটা গিয়ে কাফেতে ঢুঁ মারলে কেমন হয়?
বড্ড গরম।
ধীরে ধীরে খাব।
কাফেতে না আছে ব্র্যান্ডি, না ভোদকা। পাইগুলো খাও। তোমার খবর কী, বিয়ে করেছ?
হ্যাঁ, করেছি।
ওদের ভালোই বনিবনা আছে। আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার নাতনি স্বেতলানা বড় হচ্ছে। তুমি কী করবে? শুয়ে রেস্ট নেবে? নয়তো বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটেও আসতে পারো। এখানে আমাদের চারদিকে জঙ্গল। এ বছর প্রচুর মাশরুম হয়েছে। এত মাশরুম হয়েছে যে, বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেরা বলছে আবার যুদ্ধ না বাধে। ইয়াকোভ একেকবারে তিনশ’ করে তুলে আনে। ওক্সানা আসতে বেশি দেরি করবে না। সম্ভবত চারটের ট্রেনটাতে আসবে।
হ্যাঁ, আমি মনে মনে বললাম, আশা করি সে তাড়াতাড়ি চলে আসবে; কিন্তু তারপর? আমরা বরফ-ঠান্ডা দই দিয়ে পাইগুলো গিলব? ওর মা আর স্বামীর উপস্থিতিতে ওর সঙ্গে তিন ঘণ্টা ধরে টেবিলে বসে থাকার আমার দরকার নেই। আমার শুধু দরকার তাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা, যখন সে আমায় চিনতে পারবে তখন তার চোখ দুটি দেখা। আর কিছু নয়। পাই পরে খেলেও হবে। অন্য সময়। মাঝে মধ্যে, কচিৎ-কদাচিৎ, শুধু আমরা দু’জন, আর কেউ নয়। টেবিলে ওদের সবার সঙ্গে বসে নয়। বড় বড় কালো চোখ নিয়ে ওর মা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। উনি বিচক্ষণ বৃদ্ধা। উনি সব জানেন।
আমার জামাই কোনো অভিযোগ করে না। দাঁড়াও কোথায় যাচ্ছ? ওক্সানার কী হবে? তোমার সঙ্গে দেখা না হলে ও খুব দুঃখ পাবে। আমি জানি সে দুঃখ পাবে। বিশ্বাস করো, সে ভীষণ দুঃখ পাবে।
আমিও বলছি, বিশ্বাস করুন, ওক্সানা দুঃখ পাবে না। গুডবাই। ইয়াকোভকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। বলবেন ওর ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি বলে দুঃখিত। আমার তাড়া আছে, সত্যি।
ট্রেন থেকে নেমে ভায়াজনিকি স্টেশনের বিল্ডিংটার ভিতর দিয়ে যখন হাঁটছিলাম, আমার বহিরঙ্গ শান্ত এবং উদাসীন, কিন্তু আমার অন্তরাত্মা দোলাচরতাক্রান্ত। ছোট্ট প্রতীক্ষালয় প্রায় জনশূন্য, সুতরাং তাকে আবিষ্কার করতে আমার দেরি হয়নি। আমি তার থেকে চার পা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মাথাটা আমার দিক থেকে ঘোরানো। আমার দিকে প্রায় পিঠ করে সে বসে আছে। তার বাচ্চা মেয়েটাকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল সে, বাচ্চাটার দৃষ্টি আমার দিকে।
যখন মা দেখল তার মেয়ে কারো দিক সমানে তাকিয়ে আছে, মা-ও মুখ ফেরাল (দেখল একটা লোককে যার পরনে স্কি সø্যাক আর একটা চেক শার্ট) এবং আবার আইসক্রিমটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল; কিন্তু তার দর্শনক্ষেত্রের প্রান্তভাগে চেক শার্টটা রয়েই গেল, নড়ল না। সে আবার মুখ তুলল। এবার সে এক সেকেন্ডের প্রথম ভগ্নাংশে চোখ নামাল না. দৃষ্টি দীর্ঘতর সময় নিবব্ধ রাখল ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ দৃষ্টি নিবব্ধ রাখলে তা আদৌ নামাতে হবে না।
তার চোখ বিস্ফারিত হলো, আঁধার ঘনালো সেখানে। সেগুলো নীল রঙে ভাসতে লাগল এবং সেই নীল রং ক্রমে ঘন হয়ে জুলাই মাসের বজ্রগর্ভ মেঘের রঙের মতো হয়ে উঠল; কিন্তু বিদ্যুৎ চমকের পরিবর্তে, সবচেয়ে জোরালো বজ্রনির্ঘোষের আগে যে অশুভ ছায়া দেখা যায়, আলোর যে পরিবর্তন দেখা যায়, সে সবের পরিবর্তে, একটি সূর্যরশ্মি মনে হল যেন সেই কৃষ্ণনীলের ওপর দপদপ করে উঠল, তাকে উষ্ণ এবং ফিকে করবার জন্য তার ভিতরে জ্বলতে জ্বলতে প্রবেশ করল। ধীরে ধীরে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে স্টেশনের বাদামি বেঞ্চিটা থেকে সামান্য উঠে তারপর আচমকা একটি সশব্দ দীর্ঘশ্বাস (আ-আহ!) সহযোগে আবার ওটার ওপর ধপ করে বসে পড়ল।
আমি জানতাম, আমি জানতাম, আমি জানতাম যে কোনো না কোনো দিন আমাদের আবার দেখা হবেই। না, না, না...তোমাকে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। কুড়ি বছরে একবার। কীভাবে পারলে তুমি? আমাদের চারদিকে ঘন জঙ্গল আছে। আমরা মাশরুম তুলতে যাব। ইয়াকোভ এক এক করে তিনশো করে তুলে আনে; কিন্তু ওর সময়। বেশির ভাগ সময়েই সে কারখানায় থাকে।
আমি ভাবলাম মহিলাটিকে তার নিজের শেষ কথাগুলোয় বেশ অপ্রস্তুত বলে মনে হলো, তার মুখও হয়ে উঠল লাল।
হ্যাঁ, যে ওক্সানাকে আমি অনেক দিন আগে থেকে চিনি, সে নয়। কখনো কখনো প্রবল ইচ্ছা শক্তির দ্বারা আমি তাকে এমন একজন মহিলা হিসেবে দেখতে পেলাম যে, ঘটনাচক্রে বেঞ্চে আমার পাশে বসে আছে। তখন আমি একজন নীলনয়না মহিলাকে দেখলাম, যিনি এতটাই আকর্ষণীয়া যে তাঁকে প্রেম নিবেদন করাই যায়। উনি আমাকে ওঁর সঙ্গে জঙ্গলে মাশরুম তুলতে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। যাব?
ওক্সানা আর স্বেতলানাকে ট্রেনে তাদের সিট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমি প্ল্যাটফর্ম বরাবর ইঞ্জিনের দিকে হেঁটে গেলাম। তারপর এগজিট পর্যন্ত তারপর স্টেশনের সামনের চত্বর পর্যন্ত হেঁটে গেলাম।
ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তাদের বগিটাকে আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখব বলে আমি আরো দশ মিনিট গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমাকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওক্সানা বিস্মিত হয়নি (্আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম). যদিও আমরা যদি দশ মিনিট আগেই গুডবাই বলে থাকি তাহলে আমার আর ওখানে ঘুুরঘুর করবার কোনো যুক্তি নেই। কৃতজ্ঞচিত্তে আমার দিকে হাত নাড়ল সে, তার মেয়েও বোধহয় সম্ভবত, ট্র্রেন ছেড়ে দিলে বাচ্চারা যেমন নাড়ে। বা তার মা-ও তাকে হাত নাড়তে বলে থাকতে পারে।
আমার বন্ধু দেখলাম এইরকমভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার পিছনে হাত দিয়ে, লম্বা ঠ্যাংগুলো লোহার ফুটরেস্টের ওপর তুলে।
সেলিব্রেট করলে কেমন হয়?
তার মানে মাল টানা হবে তো? আমার বন্ধুর পা সেই মুহূর্তে মেঝেতে নেমে এলো।
ক্যান্টিনে আমরা এক বোতল ভোদকা জোগাড় করলাম।
এবার বলো কোথায় গিয়েছিলে আর কী করে ঘটনা ঘটল। টেবিলক্লথের ওপর আমাদের গ্লাসগুলো লম্বা লম্বা সোনালি ছায়া ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর আমরা স্থানীয় কবি ইভান সিমোনোভকে ফোন করলাম আর সেও চলে এলো সঙ্গে সঙ্গে। ভেবেচিন্তে দেখলে মনে হয়, সঙ্গে সঙ্গে সে আসেনি, সময়ের সব সেন্স আমার চলে গিয়েছিল।
ইভান সিমোনোভ চটপট আমাদের ধরে ফেলল আর সমানে অন্য লোকের কবিতা আবৃত্তি করে গেল। তানিয়া ছিল ভারি সুন্দর, তাদের সবার সেরা, তুষারশুভ্র বসনে তার লাল ঝালর দোলে..., আমি একদা ভালোবেসেছিলাম, সেই ভালোবাসা হয়তো এখনো..., স্টেশনের ভিড়ে আটকে পড়েছিল তুমি আর আমি..।
তখন আমার মনে হতে লাগল, এই যে আমি লোকটা, যার আছে পঁয়ত্রিশ বছরের বিপুল অভিজ্ঞতা, যে বারোটা বই লিখে ফেলেছে সে এক অন্য লোক। আমি যেন ষোলো বছরের এক ছোকরা। আমি যেন এক নম্বর ক্যান্টিনে নয়, ন্তদেনোয়ে হিলের ছাত্রাবাসে বসে আছি। আমাকে যা করতে হবে তা হলো সাহস করে দুর্বোধ্য কোনো কিছুকে জয় করা, তাহলে দশ মিনিটে আমি কার্ল মার্কস স্ট্রিটে পৌঁছে যাব। তিনটে ব্লক দূরে তার বাড়িটাকে এড়িয়ে না গিয়ে আমি দোতলায় উঠে হাত মুঠো করে দরজায় ধাক্কা দেব আর নীলনয়না স্বর্ণকেশী সে দরজা খুলবে যার বুকের ওপর একটা ছোট্ট চুনী রঙের তারা, যেন বহ্নুৎসব থেকে একটা অগ্নিময়, উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে আটকে গেছে তার ল্যাপেলে।
মূলগল্প: ভ্লাদিমির সোলুখিন, ভাষান্তর: মিরন মহিউদ্দীন